এই সরকারের প্রথম বাজেটটি পেশ করবেন নির্মলা সীতারামন, ৫ জুলাই। গত সরকারের শেষ বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছিল, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের অ্যাকাউন্টে ছ’হাজার টাকা আয়-ভর্তুকি দেওয়া হবে। কিন্তু, তার জন্য বাজেটে কোনও টাকা বরাদ্দ করা হয়নি। আরও ঘোষণা করা হয়েছিল, যাঁদের বার্ষিক আয় পাঁচ লক্ষ টাকার কম, তাঁদের কোনও আয়কর নেওয়া হবে না। যদি অন্য সব সূচক অপরিবর্তিত থাকে আর সরকার সত্যিই নির্বাচন-পূর্ব প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে চায়, তবে সরকারের ব্যয় বাড়বে আর কর বাবদ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমবে বলেই অনুমান করা যায়। অর্থাৎ, রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা। এ দিকে, আর্থিক বৃদ্ধির হার আগের অনুমানের চেয়ে কম থাকবে বলেই হিসেব। ফলে, দেশের গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট (জিডিপি) বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাতে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক পুঁজির চোখে এমন পরিস্থিতি খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে, মুডিজ়-এর মতো আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা ভারতের রেটিং কমিয়ে দিতে পারে, তেমন আশঙ্কাও রয়েছে। অতএব, এই বাজেটের জোড়া লক্ষ্য— আন্তর্জাতিক পুঁজিকে না চটানো, আবার দেশের মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা।
দেশের অবস্থা ঠিক কী রকম? কর্মসংস্থানহীনতার ছবিটি ভয়াবহ। গত পাঁচ বছরে গ্রামীণ মজুরির হার মোটে বাড়েনি। সাম্প্রতিক কালে শহরাঞ্চলেও ঘণ্টাপিছু মজুরির প্রকৃত হার তেমন ভাবে বাড়েনি। শেষ কয়েক বছরে ভারতের সিংহভাগ মানুষের আয় আটকে রয়েছে কার্যত একই জায়গায়। তার পাশাপাশি বেকারত্ব বেড়েছে। এই মুহূর্তে এটাই বৃহত্তম সমস্যা। বাজেটে এই সমস্যাটিকে স্বীকার করতে হবে, এবং কী ভাবে তার থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, সে পথও সন্ধান করতে হবে। আশা, এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমানোর ভুল সরকার করবে না।
কর্মসংস্থানের সুযোগ কেন কমছে? মজুরির প্রকৃত হার কিছুতেই বাড়ছে না কেন? মূলত তিনটি কারণে। এক, বাজারে যথেষ্ট চাহিদা না থাকায় বিনিয়োগকারীরা লগ্নি করতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের আশঙ্কা, লগ্নি করে যে পণ্য তাঁরা উৎপাদন করবেন, তা হয়তো বিক্রিই করা যাবে না। বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে মোট যত নন-ফুড ক্রেডিট দেওয়া হয়েছে, জাতীয় আয়ের অনুপাতে গত কয়েক বছরে তার পরিমাণ ক্রমশ কমছে। নির্মাণক্ষেত্রও শ্লথ হয়েছে। উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এটা ঠিক সময় কি না, লগ্নিকারীরা সে বিষয়ে নিশ্চিত নন। ভারতের বাজারে প্রত্যাশিত লাভের হারও সামগ্রিক ভাবে তলানিতে। অর্থাৎ, ব্যবসার বাজারে একটা সার্বিক মন্দা চলছে। তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর। বাজেটে এই দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়া খুব জরুরি। ভারতে লগ্নিকারীদের মনে ভরসা তৈরি করার কথা বললেই শুধু হবে না, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু বড় ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, ছোট ও মাঝারি আয়তনের ব্যবসার ক্ষেত্রেও ভরসা জোগাতে হবে। যাঁরা বাড়িতে বসেই পণ্য উৎপাদন করেন, বা নিজের কর্মসংস্থান হওয়ার মতো ছোট ব্যবসা করেন, তাঁদেরও এই ভরসা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা জরুরি যে কর্পোরেট করের হার কমালে, ঋণের ওপর সুদের হার কমালে বা মজুরি বাড়তে না দিলেই প্রত্যাশিত লাভের হার না-ও বাড়তে পারে। তার জন্য বাজারে সামগ্রিক চাহিদার পরিমাণ বাড়াতে হবে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। অসাম্যের পরিমাণ কমাতে হবে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যথেষ্ট কর্মসংস্থান করার মতো বেসরকারি লগ্নি যখন হচ্ছে না, তখন রাষ্ট্রীয় ব্যয় না বাড়ালে উপায় নেই। ১৯৯১ সালে আর্থিক সংস্কারের পর থেকে গত তিন দশকে আমরা শুধু বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বন্ধ হয়ে যেতে দেখেছি, তার বিলগ্নিকরণ দেখেছি। এ বার উল্টো পথে হাঁটা জরুরি। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে লগ্নির পরিমাণ বাড়ুক, যাতে যথেষ্ট কর্মসংস্থান হয়, আয়বৃদ্ধির হার বাড়ে। পরিকাঠামোর মতো স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়লে তাতে বেসরকারি পুঁজি আকৃষ্ট হয়। এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয়, বিশেষত জিএসটি চালু হওয়ার পর কেন্দ্রের হাতে কর আদায়ের ক্ষমতা আরও বাড়ার ফলে— রাজ্যগুলির পক্ষে মূলধনী খাতে ব্যয়বৃদ্ধির বিশেষ উপায় নেই। ফলে, সেই দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরই বর্তায়। এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী জাতীয় আয়ের অনুপাতে বেশি মূলধনী ব্যয়ের পথে হাঁটলে বুদ্ধিমানের কাজ করবেন।
বেকারত্বের হার বাড়ার, এবং মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা কমার তৃতীয় কারণটি হল ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বা প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির ওপর অতিনির্ভরশীলতা; আর, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সামাজিক ক্ষেত্রকে অবহেলা করা। ভারতে এফডিআই-এর চরিত্র ঠিক কী, সেটা স্পষ্ট। এই টাকার একটা বড় অংশ ভারতেরই টাকা, সিঙ্গাপুর বা মরিশাসের মতো কর-ছাড়ের স্বর্গ থেকে ঘুরিয়ে আনা, যাতে দেশে কর দিতে না হয়। বাকি টাকা মূলত আসে দু’টি সংস্থার সংযুক্তিকরণ বা পুরনো সংস্থা কেনার জন্য। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মতো নতুন বিনিয়োগ সেই টাকায় হয় না বললেই চলে। অন্য দিকে, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো ক্ষেত্র ক্রমশ বেসরকারি হাতে চলে যাওয়ায় এগুলোর পিছনে সাধারণ মানুষের খরচ গড়ে বহু গুণ বেড়েছে। দেশে অর্ধ-শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বিপুল— সেখানে বিমাভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থার পথে হাঁটলে তা খুব কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনাও কম। সরকার যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল বা নিকাশির মতো জিনিসগুলোর দায়িত্ব নেয়, তা হলে সাধারণ মানুষের হাতে ব্যয়যোগ্য টাকার পরিমাণ বেশ খানিকটা বাড়বে। তাঁদের কেনাকাটাও বাড়বে, ফলে বাজারে চাহিদা তৈরি হবে। লগ্নিকারীরাও নতুন করে টাকা ঢালার সাহস পাবেন। তাতে সামগ্রিক ভাবে কর্মসংস্থানের হারও বাড়বে।
এ বারে মূল প্রশ্ন— সরকার কি রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের পরিমাণ বাড়াতে পারে? যদি জিডিপি-র অনুপাতে কররাজস্ব আদায়ের পরিমাণ না বাড়ে, তবে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়লেই রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণও বাড়বে। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং সব রাজ্য সরকারের হিসেব মিলিয়ে কর আদায়ের অনুপাত দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাত্র ১৬.৫%। গোটা দুনিয়ায় খুব কম দেশেই এই অনুপাত এতখানি কম। কিন্তু, ভারতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, কোনও করের হারই আন্তর্জাতিক হারের তুলনায় কম নয়। তা হলে সমস্যা কোথায়? একটা সমস্যা হল, উন্নত দেশগুলোর তুলনায় ভারতে কম লোকের থেকে কর আদায় করা হয়, কারণ এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই এখনও গরিব। কিন্তু, সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত দেশগুলির তুলনায়, বা লাতিন আমেরিকার দরিদ্রতম দেশগুলির তুলনাতেও আমাদের দেশে কর-জিডিপির অনুপাত কম। গত বছর শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের আদায় করা জিএসটি-তেই ঘাটতি ছিল দেড় লক্ষ কোটি টাকার। রাজ্যগুলির ঘাটতি মিটিয়ে দেওয়ার পর কেন্দ্রের ঘাটতির পরিমাণ আরও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। তার ফলে, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে খরচ করার মতো টাকার পরিমাণও কম হবে। কাজেই, এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের একটা মস্ত দায়িত্ব হল কর প্রশাসনকে আরও শক্তপোক্ত করে তোলা, করসংক্রান্ত তথ্য জোগাড়ে আরও মন দেওয়া, কড়া হাতে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা। আমার মতে, এই বাজেটে সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব হল দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাতে কর আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধিতে মন দেওয়া, যাতে খরচ করার জন্য সরকারের হাতে বেশি টাকা থাকে।
প্রত্যক্ষ কর চরিত্রে প্রগ্রেসিভ, অর্থাৎ যার আয় যত বেশি, তার থেকে আয়ের অনুপাতে কর আদায়ের পরিমাণও তত বেশি। অন্য দিকে, পরোক্ষ কর চরিত্রে রিগ্রেসিভ, অর্থাৎ ধনী তাঁর আয়ের যত শতাংশ এই কর দিতে ব্যয় করেন, গরিবকে ব্যয় করতে হয় তার চেয়ে বেশি অনুপাতে। কাজেই, মোট কর আদায়ের পরিমাণে আয়কর, প্রফিট ট্যাক্সের মতো প্রত্যক্ষ করের অনুপাত যদি বাড়ে, আর জিএসটি-র মতো পরোক্ষ করের অনুপাত যদি কমে, তা হলে সমাজে অসাম্য কমবে। অসাম্যের কথাটি মাথায় রেখে এই বাজেটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের অনুপাতের দিকেও নজর দেওয়া উচিত। আর, রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ যদি বেড়েও যায়, তবুও মূলধনী খাতে এবং সামাজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে কাটছাঁট করা চলবে না। বেকারত্ব কমাতে, আয়বৃদ্ধির হার বাড়াতে এই খরচ জরুরি।
লেখক দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy