আজ থেকে প্রায় এক বৎসর আগে আচমকাই আমাদের ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। যখন অতিমারির প্রাথমিক ধংসলীলার পর স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সহায়তা সব থেকে বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল, তখন সরকারের এই রূপ ঔদাসীন্য ও অবজ্ঞা অনেকেরই দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই। যখন পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত ও কর্মবিরত মানুষের প্রয়োজন ছিল আরও কিছুটা রাষ্ট্রীয় আশ্বাস; ঠিক তখনই তাদের উদ্দেশ্যে বার্তা দেওয়া হল: নিজে নিজেরটা দেখে-বুঝে নিন।
এই কঠোর বার্তা ও চরম নির্মমতার উদাহরণ আমরা পেলাম ২০২১-এ। উন্মোচিত সমাধি, ভাসমান লাশ ও অক্সিজেনের ঘাটতির ছবির মাধ্যমে প্রকট হল আত্মনির্ভরতার মর্মান্তিক অ(ন)র্থ। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গোটা দেশ বুঝল আত্মনির্ভরতার আর এক মানে— মরণকালেও এবং মরণোত্তর কালেও রাষ্ট্রীয় সহায়তার গণঅধিকার কতখানি অমূলক। সেই সঙ্কটের মুহূর্তে আমরা অনেকেই বুঝলাম, আত্মশক্তির প্রকৃত অর্থ এ দেশে জন্মাবার ও মরবার ‘শক্তি’— যেখানে জীবন, জীবিকা এবং জীবনের অধিকার সকলই হতে পারে নিমেষে বিলীন। খাদ্যাভাব, জলাভাব, অক্সিজেনাভাব— কিছুর জন্যই রাষ্ট্রকে দায়ী করা চলে না। এ এক নতুন ‘আত্ম-সম্বল’ ভারতবর্ষ বইকি।
‘আত্মনির্ভর’ ও ‘আত্মশক্তি’— এই দুই শব্দের প্রচলন ও মুদ্রণ এই প্রথম বার হচ্ছে, এমনটা নয়। অনেকেরই ধারণা, এই শব্দ দু’টির উদ্ভব ও প্রয়োগ মোদীর ‘মন কি বাত’-এ। অথচ একশো বছরেরও বেশি আগে ‘নেশন কী?’, ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’, ‘স্বদেশী সমাজ’, ‘সফলতার সদুপায়’, ও ‘দেশীয় রাজ্য’ প্রবন্ধগুলিতে রবীন্দ্রনাথ বহু বার বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ‘আত্মনির্ভর’ ও ‘আত্মশক্তি’র অর্থ ও তার তাৎপর্য বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন। আত্মনির্ভরতা তাঁর কাছে এক মহৎ অভিপ্রায়, যার ভূমিকা দেশকল্যাণের পথে জরুরি। আত্মশক্তির দ্বারাই এই স্বনির্ভর ‘স্বদেশি’ বাস্তবায়িত করা সম্ভব।
বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের সেই আত্মনির্ভরতা ও আত্মশক্তির বিচারবোধ, কোনও ফাটকা ভাবমূর্তি-গঠনের বিজ্ঞপন-বাণী নয়; তা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সুচিন্তিত ও দৃঢ় এক সঙ্কল্প। ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির সমালোচনায় লেখা প্রবন্ধগুলিতেও তিনি ফিরে ফিরে আসছেন একই মূল বক্তব্যে: যে শাসক সাম্রাজ্য বিস্তার করতে এসেছেন, যাঁর শাসনের আর্থ-সামাজিক ভিত্তিই বলপূর্বক শোষণ ও উৎপাটন— তাঁর কাছে দরখাস্ত করে, ভিক্ষে করে, দাবি করে, অনুরোধ করে, উত্তেজিত বক্তৃতা আওড়ে বিশেষ কিছুই পাওয়া যাবে না। তাতে আত্মমর্যাদা স্খলনের প্রচুর সম্ভবনা থাকলেও, গণকল্যাণমূলক কর্ম সাধন অসম্ভব। শাসক ও উপনিবেশের সম্পর্কের মূলেই রয়েছে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অসমতা ও বশ্যতাস্বীকারের আখ্যান।
আরও সহজ করে বলতে গেলে, অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে, স্বনির্ভর হওয়ার সদিচ্ছের উপর জোর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বাইরের শক্তি এসে আমাদের উপকার করবে, এমন ভাবনা করতে তিনি বারণ করেছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পোন্নয়ন, পরিকাঠামো, পরিষেবা উন্নয়নের দায়ভার এড়িয়ে না গিয়ে, নিজ স্কন্ধে তা সাগ্রহে তুলে নিয়ে বহন করতে শিখতে হবে। এই নির্ভীক মানসশক্তিই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি চিন্তার মূলে। প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছিলেন: অন্য কারও কাঁধে চড়ে স্থানান্তর সম্ভব হলেও তাকে প্রগতি বলা চলে না—“অপর ব্যক্তির কোলেপিঠে চড়িয়া অগ্রসর হওয়ার কোনও মাহাত্ম্য নাই, কারণ চলিবার শক্তি লাভই যাথার্থ্য লাভ, অগ্রসর হওয়ামাত্রই লাভ নহে।”
এই হিতকারী স্বদেশি সঙ্কল্প প্রতিষ্ঠিত দু’টি স্তম্ভের উপর। এক, পাশ্চাত্যের অন্ধ অলস অনুকরণ বর্জন, এবং দুই, ভারতবর্ষের সভ্যতা ও ঐতিহ্যের মূলে যে প্রবণতা ও প্রাণশক্তি, সেই ভাষা-বর্ণ-ধর্ম-প্রথার বিবিধতাকে বরণ করার ঔদার্য। সেই গতিপথ আদতে মানবিক, উদার ও মিলনমুখী।
বৈষম্যকে বা পার্থক্যকে বধ নয়, তাকে ধারণ করেই সেই আত্মশক্তির বিকাশ, বিস্তার ও অস্তিত্ব— বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যসাধন। পণ্য-অস্ত্র-বাণিজ্যের বলে গড়ে ওঠা আগ্রাসী পাশ্চাত্যের ‘নেশন’-ধারণা স্বদেশজাত নয়— কারণ তা শক্তির আস্ফালন ও ঔদ্ধত্যে মোড়া বিভাজন, নিপীড়ন, প্রভেদ ও লাঞ্ছনার উপর প্রতিষ্ঠিত। ভিন্ন দেশে লালিতপালিত, পরিস্ফুট সেই নেশন-ধারণার প্রবাহের সঙ্গে আমাদের স্বদেশি চেতনার বিস্তর অমিল। রাবীন্দ্রিক স্বদেশি চেতনার ভিত্তি, প্রশাসনিক দক্ষতা নয়, বরং হিতকারী সমাজের ন্যায় বিচারের সহজাত প্রবণতা। অর্থাৎ সরকারের ঊর্ধ্বে সমাজ ও সামাজিক সহযোগিতা।
আর ঠিক এ-হেন সময়ে, সেই সামাজিক সহযোগিতাই একমাত্র ভরসা। অতিমারির এই অভূতপূর্ব প্রকোপের সময়ে, ‘আত্মনির্ভরতা’ ও ‘আত্মশক্তি’র অভিসন্ধিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বাণী, আমাদের অসহায়তাকে হেয় করে বারংবার। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত রেখে রাষ্ট্র অনায়াসে উধাও হয়ে যায়। প্রয়োজনে সমস্ত দায়ভার ঝেড়ে ফেলে, নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে, বিনামূল্যে-টিকার বিজ্ঞপনে আশীর্বাদী বার্তা নিয়ে আত্মবিজ্ঞাপনের আড়ম্বর দেখায়।
আরও এক বার প্রমাণিত হয়, আজকের ভারতে আত্মনির্ভরতা বলতে নাগরিককে বুঝতে হবে— কোনও রাষ্ট্রীয় প্রয়াস নয়, কোনও আত্মশক্তির উন্নয়নও নয়— বরং দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নাগরিকের উপায়হীন, সম্বলহীন অসহায়তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy