গল্প না শুনে বড় হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। মানুষের সমস্ত শৈশবকে আচ্ছন্ন করে রাখে গল্প। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকলের মনের মধ্যে বাস করে এক কৌতূহলী মন। সামান্য গল্পের গন্ধ পেলেই সেই মন আগ্রহে টানটান হয়ে বসে। ‘এক যে ছিল রাজা’ শুনলেই উৎকর্ণ আগ্রহের সৃষ্টি হয়। শিশুদের ঘুম পাড়াতে বা ভাত বেশি খাওয়াতেই শুধু গল্পের প্রয়োজন হয় না, লোকজীবনে বহু শ্রমসাধ্য কাজ করার সময়, মাঠে ফসল পাকলে রাত পাহারা দেওয়ার সময়, প্রবল বর্ষায় চাষের বিরতিতে একঘেয়ে ক্লান্তিকর সময় কাটানোর জন্যও প্রয়োজন পড়ে গল্পের। আমাদের দেশ ভারত বহু গল্পের এক অনবদ্য ভান্ডার। বিভিন্ন ভাষায় বিচিত্র সব গল্প সমগ্র দেশের জনজীবনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া এই সমস্ত গল্পের স্রষ্টা সাধারণ মানুষ এবং এদের ধারক ও বাহক সাধারণ জনসমাজ।
ভারতের এই বিচিত্র গল্পের সংখ্যাধিক্যের কারণেই ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা ভারতকে সমস্ত গল্পের আদিভূমি বলে মনে করেন। যদিও এ নিয়ে দ্বিমতও আছে। এ সমস্ত গল্পের বয়সের গাছ-পাথর নেই। যেখানে মানুষ সেখানেই গল্পের জন্ম। ধর্মশিক্ষা থেকে শুরু করে নীতিশিক্ষা এক কালে সবই চলত গল্পের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। লোকজীবন থেকে উদ্ভুত এই সব গল্পের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এই গল্পে দুর্বলেরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়। শক্তিশালী বা সমাজের তথাকথিত উচ্চশ্রেণির প্রতিভূদের পরাজয় ঘটে ও অসহায় ও দুর্বলের নৈতিক জয় হয়। সাধারণ জনতা এই গল্পগুলির মধ্যে নিজেদের স্বপ্নপূরণ ঘটায়। যা অপ্রাপ্য, যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে, সেগুলি গল্পের মধ্যে পূর্ণতা পায়। কালকেতু সাত ঘড়া ধন পায়; বেহুলা লক্ষীন্দরের প্রাণ ফিরে পায়। সমাজের নিচু তলার বাসিন্দারা বহুকালের অপমানের প্রতিশোধ নেয়। টুনটুনি ও বেড়ালের গল্পে টুনটুনি শেষ পর্যন্ত তথাকথিত শক্তিশালী বেড়ালকে লাথি দেখায়। এ সব গল্পে বিজোড় সংখ্যা তিন বা পাঁচের প্রতি আনুগত্য লক্ষ্য করা যায়। তিন সত্য, তিন বর, তিন বার ডুব দেওয়া ইত্যাদি খুব সাধারণ বিষয়। লোকজীবন সম্ভূত এই সব গল্পের সুচারু রূপ সংস্কৃত কথাসাহিত্যে, পঞ্চতন্ত্রে, হিতোপদেশে পাওয়া যায়।
সমগ্র দেশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র গল্প সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয়েছিল পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, ও অন্য ইউরোপীয় মিশনারিদের হাত ধরে। মূলত ভারতীয় জনজীবন সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরির জন্যই তাঁরা গল্পগুলি সংগ্রহে মন দেন। পরবর্তীকালে রেভারেন্ড লালবিহারী দে, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ছড়িয়ে থাকা এ সকল গল্প সংগ্রহ ও সংকলন করে প্রকাশ করেন।
জনজীবনে ছড়িয়ে থাকা গল্পগুলি কথা, কাহিনি, কিস্্সা/কিচ্ছা, শাস্তর, শোলক প্রভৃতি নানা নামে বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচলিত।
আমাদের মুর্শিদাবাদের গ্রামাঞ্চলে গল্প বলার আসর বসে সাধারণত রাতে। গ্রামীণ মানুষের জীবনে বিনোদনের বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় গ্রামীণ জনতা ভিড় করেন গল্পের আসরে। গল্প যাঁরা বলেন, ব্যক্তিজীবনে তাঁরা নানা পেশার সঙ্গে যুক্ত। শুধুমাত্র গল্প বলা কারও পেশা নয়। তাই সন্ধ্যার আঁধার নামলে তবেই গল্পের আসর বসে। এই আসরে ক্ষুদ্র গল্প যেমন বলা হয়, দীর্ঘায়িত গল্পেরও সন্ধান পাওয়া যায়। বহু গল্পে গান বা ছড়া যুক্ত থাকে। বিশেষত গানের গল্পগুলি বেশ বড় হয়। গল্পের আকর্ষণীয় স্থানে শেষ করে পরের দিন রাতে আবার সেখান থেকে আরম্ভ হয়। কথক যদি ভাল গায়ক হন তা হলে গানের গল্প জমে আরও বেশি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায়, কথক গল্প বলেন এবং গানের সময় অনেকে মিলে গানগুলি ধরেন। কিছু গল্পে গানের সঙ্গে যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহার দেখা যায়। কোনও গল্প হয় একমুখী, সরল; আবার কিছু গল্প হয় জটিল। সাধারণ ভাবে বড় গল্পগুলি নানা শাখা-প্রশাখা যুক্ত হয়।
একটা গল্প শুনে যে কেউ সেটাকে বলতে পারেন, কিন্তু ভাল গল্প বলার জন্য কথকের নিজস্ব দক্ষতার বিশেষ প্রয়োজন আছে। গল্প বলার কায়দা এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাথা নাড়িয়ে, নানা অঙ্গভঙ্গি সহকারে গল্প বলে গল্পকথক একটি গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন। তিনি একাই বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে গল্পকে দৃশ্যকাব্যে পরিণত করেন। ইউরোপের নানা দেশে, চিন ও জাপানে গল্প বলার জন্য পেশাদার গল্পকথকেরা থাকেন। কিন্তু আমাদের গ্রামবাংলায় তেমন পেশাদার গল্পকথকেরা অনুপস্থিত। তবে ভাল গল্প বলে বহু মানুষকে একসঙ্গে মুগ্ধ করেন এমন কথক কিন্তু মোটেও অমিল নয়।
এক মুখ থেকে অন্য মুখে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে গল্পগুলি এক সময় নিজস্ব গণ্ডী অতিক্রম করে দূর দূরান্তে পাড়ি দেয়। গল্পের এই ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতার জন্যই ভারতীয় উপমহাদেশের গল্পের সঙ্গে ইউরোপীয় বহু গল্পের সাদৃশ্য রয়েছে। লোকের মুখে মুখে বারংবার কথিত হয়েই গল্পেরা বেঁচে থাকে। বারবার কথনে একটি গল্প একটু একটু করে পাল্টে যায়। মূল কাঠামোটি অপরিবর্তিত থাকলেও গল্পের বহিরঙ্গে নানা সংযোজন-বিয়োজন ঘটে। এমনকি একই কথক একই গল্প দু’বার বললেও গল্পের কিছুটা পরিবর্তন হয়ে যায়। তবে এই পরিবর্তনই গল্পকে পুনর্জীবন দেয়।
গ্রামবাংলায় সারা বছর ধরে নানা ধরনের গল্প শোনা যায়— ধর্মীয় গল্প, পৌরাণিক গল্প, মজার গল্প, রূপকথার গল্প, ভূত, প্রেত, দৈত্য, দানোর গল্প, পশু পাখির গল্প, শ্লীল-অশ্লীল নানা গল্প। পণ্ডিতেরা গল্পের নানা সূক্ষ্ম বিভাজন করে থাকেন কিন্তু গল্পের এই বিভাগ নিখুঁত নয়। কারণ, এক ধরনের গল্পের সঙ্গে অন্য গল্প অনায়াসে মিশে যায়। ব্রতকথার গল্পে রূপকথা প্রবেশ করে, পশুকথার গল্পে নীতিকথা ঢুকে যায়। বহুপ্রচলিত এই গল্পগুলি ছাড়াও গ্রামীণ জীবনের নিজস্ব কিছু গল্প থাকে যার মধ্যে সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার কথা জমে থাকে। প্রেম, হিংসা, ভালবাসা, বন্ধুত্ব, লোভ, ঈর্ষা ইত্যাদি মানবিক অনুভূতিগুলি ভাষা পায় এ সব গল্পে। গ্রামীণ জীবনের গল্পে লগ্ন হয়ে থাকে সামাজিক নানা বিধিনিষেধ, রীতিনীতি যা একান্ত ভাবেই বাঙালি সমাজের প্রতিচ্ছবি।
গল্পকথক ও তাঁদের বলা গল্পের প্রসঙ্গ বারবার ফিরে ফিরে এসেছে সাহিত্যেও। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে আমাদের মালার সঙ্গে পরিচয় হয়। ‘গল্প বলিতে সে ওস্তাদ। একই গল্প বারবার বলিয়া শ্রোতাদের সে সমান মুগ্ধ করতে পারে। গোপী সরিতে সরিতে মার গা ঘেঁষিয়া আসে। পিসী ঠায় বসিয়া থাকে দুয়ারের কাছে। মালার গল্প শুনতে আরো কে কে আসিয়া পড়িয়াছে দেখো গণেশের বৌ উলুপী, ছেলে মনাই আর মেয়ে কুকী। আর আসিয়াছে সিধুর তোতলা হাবা মেয়ে বগলী। কথা বলিয়া কেহ মালার রূপকথা বলায় বাধা দেয় না, চুপচাপ শুনিয়া যায়।’
কোথায় গেলেন মালা কিংবা সেই সব ঠাকুমা, দিদিমারা যাঁরা গল্প বলে আমাদের জীবনকে মায়াচ্ছন্ন করে রাখতেন? টিভি, ইন্টারনেটের প্রবল আধিপত্যে আমাদের জীবন থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে গল্প, হারিয়ে যাচ্ছেন কথকেরা। ঐতিহ্যবাহিত এই গল্পগুলি হারিয়ে গেলে হারিয়ে যাবে আমাদের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, লোকাচার। গল্পের ভুবন থেকে সরে গিয়ে শৈশব আজ বিপন্ন। তাই গল্পগুলিকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। বারবার বলে গল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার এ বড় যোগ্য মুহূর্ত।
শিক্ষিকা,
মণীন্দ্রনগর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy