জানুয়ারি মাস আসিলেই ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের সেই রায়টির দুই বৎসর বয়স হইবে, যাহাতে বলা হইয়াছিল চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সময় জাতীয় সঙ্গীত বাজানো আবশ্যিক নহে। দুই বৎসর ধরিয়া অবশ্য মোটেই এই রায় মান্য করিয়া চলা হয় নাই। দেশের প্রতি সিনেমা হলে প্রত্যহ প্রতি শো-তে জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়াছে। অনুমান করা চলে, এক বার ‘জাতীয়তা’র মহান উদ্যাপন শুরু হইবার পর কাহারও দুঃসাহস হয় নাই, এমন একটি নিয়মিত বিশ্বস্ততা প্রদর্শন হইতে সরিয়া আসিবার, বিনোদনচটুলতার আগেও বাধ্যতামূলক ভাবে দাঁড়াইয়া জাতীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের প্রথা লঙ্ঘন করিবার। এই যে গড্ডলিকা-সমান আত্মপ্রত্যয়হীন অবশ-চিত্ত ভয়চকিত দেশপ্রেম, ইহা স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটির পরবর্তী স্তবকটি মনে রাখে না— যেখানে ভারতের বৈচিত্র-আকীর্ণ উদার ‘জাতীয়তা’র জন্যই গীতিকারের গভীর প্রণতি নিবেদিত হইয়াছিল: ‘‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত শুনি তব উদার বাণী/ হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী/ পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে/ প্রেমহার হয় গাঁথা।’’ নানা ধর্ম নানা ভাষা নানা সংস্কৃতি মিলিয়া মিশিয়া যে উন্মুক্ত বিস্তার, জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা ‘ভারতীয়ত্ব’ বলিতে তাহাই বুঝিয়াছিলেন। কেবল তিনি নহেন, ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতারা এবং ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রথম নেতারাও তাহাই প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিয়াছিলেন। তাঁহাদের সকলের সম্মিলিত-দৃষ্টির সেই উদার-জাতীয়তার কল্যাণেই ভারত শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের মতো সামরিক কর্তৃত্ববাদের দমনপীড়ন দেখে নাই, সোভিয়েতের মতো উপরিতলের আপাত-একতার তলায় বিচ্ছিন্নতাবাদের বিস্ফোরণ দেখে নাই, চিনের মতো রাষ্ট্রশক্তির নিষ্পেষিত প্রজাসাধারণ তৈরি করে নাই। ভারতের বিশিষ্ট চরিত্র, যাহা গণতন্ত্র-ভুবনে নিশ্চিত ভাবেই অ-তুলনীয়— ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ-র বর্ণনায়, ‘সুই জেনেরিস’ বা অনন্যসাধারণ।
না, বর্তমান ভারত নহে। ইহা সম্প্রতি-অতীত ভারতের কথা। গত পাঁচ বৎসরে ভারতবর্ষ গভীর ও ব্যাপক ভাবে ভাঙিতে শুরু করিয়াছে। কেন, সেই আলোচনায় নূতন করিয়া যাইবার দরকার নাই। এইটুকু বলাই যথেষ্ট, পাঁচ বছরে কেন্দ্রীয় শাসকের কাজকর্ম ভাবনাচিন্তার ফল— ভারতের ওই বিস্তৃত উদার ঐক্য আজকাল কোনও না কোনও কারণে প্রতি দিন ধ্বস্ত, ক্ষুব্ধ, পীড়িত। কাশ্মীর আটক। উত্তর-পূর্বের রাজ্যসমূহ বিক্ষোভাগ্নিতে জ্বলিতেছে। পশ্চিমবঙ্গ ফুঁসিতেছে। মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের সমাজও ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইতে বসিয়াছে। অবাক করিতেছে রাজধানী। দিল্লির এ-হেন ক্রোধোন্মত্ত রূপ ইতিপূর্বে দেখা গিয়াছে কি? ২০১৯-র ভারত আক্ষরিক অর্থেই ‘টুকড়ে টুকড়ে’!
একটি একত্রিত দেশীয় অস্তিত্বকে খণ্ডিত করিবার বহুবিধ পন্থা আবিষ্কৃত হইয়াছে। মুসলমান-বিদ্বেষ, বলা বাহুল্য, প্রধান পথ। এই এক অস্ত্রেই সমাজের ঐক্য ও স্থিতি বিদীর্ণ হইবার মুখে। তাহার পর দলিত-বিরোধিতা— ভেমুলা-যুগের তীব্র পারস্পরিক ঘৃণা ও সংঘাত। নারীনির্যাতন— যাহা সুনামির আকার লইয়াছে। ছাত্রসমাজ ও সাংবাদিকসমাজের উপর নিপীড়ন ব্রিটিশযুগের সমস্ত উদাহরণকে ছাপাইয়া গিয়াছে। প্রাদেশিকতার লেলিহান আগুনে প্রাণহানির সংবাদ জলভাত হইয়াছে। যাঁহারা ভারতকে এই ভাবে চূর্ণবিচূর্ণ করিতেছেন, তাঁহারাই আবার বাণী দিতেছেন ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’কে শিক্ষা দিবার জন্য! অবশ্যই তাঁহাদের চোখে যে কোনও প্রতিবাদীই ‘গ্যাং’-এর সদস্য। ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর দড়িতে দেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে না বাঁধিয়া উদার ঐক্যের ভাবনায় বাঁধিতে চাহিলেই নামিয়া আসিতেছে আক্রমণ ও বিপদ। কিন্তু না, অবসন্ন হইবার অবকাশ নাই। পুরাতন ভারত যাহাতে টুকরো টুকরো হইয়া অকালমৃত না হয়, তাহা দেখিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy