বিধানসভা চলাকালীন সেচ দফতরে দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন তুলিতে চাহিয়াছিলেন বিরোধীরা। বাম বিধায়কদের সেই বক্তব্য সভার কার্যবিবরণীতে স্থান পায় নাই, পরে সংবাদমাধ্যমের নিকট তাঁহারা প্রশ্নগুলি জানাইয়াছেন। সেচমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর প্রতিক্রিয়া, যাঁহারা সাত-আট শতাংশ ভোট পাইয়াছেন, তাঁহাদের কথা ‘অবান্তর’ এবং ‘গুরুত্বহীন।’ মনে হইতে পারে, ইহা আর আশ্চর্য কী? ক্ষমতাবানের ঔদ্ধত্যের এমন প্রকাশ দেখিয়াই তো রাজ্যবাসী অভ্যস্ত। সেচমন্ত্রীর কণ্ঠে যেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি ফের শুনিল রাজ্যবাসী— ‘‘আমরা দু’শো পঁয়ত্রিশ, ওরা ত্রিশ।’’ পার্থক্য ইহাই যে, তিনি গণিয়াছিলেন আসন, আর শুভেন্দু গণিলেন ভোটের ভাগ। ২০০৬ সালে বিপুল ভোটে জিতিয়া আসিবার পর যে স্পর্ধাবাক্য উচ্চারণ করিয়াছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, তাহার উত্তর পাইয়াছিলেন পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে। সত্যই, রাজনীতির দৃষ্টিতে ইহা সংখ্যাধিক্যের ঔদ্ধত্য ভিন্ন কিছু নহে। কিন্তু তাহাতেই ইহার তাৎপর্য সীমাবদ্ধ নহে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কথাগুলি সে দিন শুধু বিরোধীকে নহে, রাজ্যবাসীকেও আহত করিয়াছিল। নাগরিকের ক্ষোভ বিরোধীর বক্তব্যে প্রতিফলিত হইবে, তাহাদের প্রশ্ন বিরোধী নেতার কণ্ঠে ধ্বনিত হইবে, ইহাই প্রত্যাশিত। অতএব বিরোধীকে তাচ্ছিল্য কেবল অসৌজন্য, অভদ্রতা নহে, তাহা জনকণ্ঠের অবমাননা। নিয়তির পরিহাস যে সে দিন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিরোধীদের বক্তব্য শুনিতে রাজি হন নাই, আর আজ তাঁহার দলের নেতাদের কথা শুনিবার কেহ নাই।
কৃতকর্মের ফল মিলিবে, তাহা আশ্চর্য নহে। আশ্চর্য ইহাই যে, সে দিনের পরম শিক্ষাটি এত শীঘ্র ভুলিয়াছে তৃণমূল কংগ্রেস দল। সে দিনের বামফ্রন্টের মতো আজিকার তৃণমূলও যেন ভাবিয়াছে, নির্বাচনে জনসমর্থনের অর্থ নির্বাচিত সরকারের প্রতি সকল প্রশ্নে নিঃশর্ত সমর্থন। অথচ সরকারি ক্ষমতার অপর পিঠ যে নেতার দায়বদ্ধতা, সেই সত্যটি ভুলিলে গণতন্ত্র ধোঁকার টাটি হইয়া দাঁড়ায়। নহিলে বিরোধীর ভোট সাত শতাংশ নাকি সাতাশ শতাংশ, তাহা কী রূপে প্রশ্নের গুরুত্ব নির্ধারণ করিতে পারে? দুর্নীতির অভিযোগ করিতে হইলে কত ভোট পাইতে হইবে, তাহা কে নির্ণয় করিল? রাজ্যের যে সাত শতাংশ বামপন্থীদের ভোট দিয়াছেন, তাঁহারাও যে এই রাজ্যেরই নাগরিক এবং ক্ষমতাসীন সরকার কেবল নিজেদের সমর্থকদেরই নহে, এই বিরোধী ভোটারদেরও প্রশাসক, এবং সমান প্রশাসক, শুভেন্দু অধিকারীরা সেই কথাটি ভুলিয়া গণতন্ত্রের সম্মান বাড়ান নাই। হাসিম শেখ বা রামা কৈবর্তরা নিজেদের গৃহাঙ্গনে দাঁড়াইয়াও প্রশ্ন করিতে পারেন। মন্ত্রী তাহার উত্তর দিতে দায়বদ্ধ। করদাতার টাকার অপব্যয় হইয়াছে কি না, এ প্রশ্ন করিতে কোনও যোগ্যতা অর্জনের প্রয়োজন নাই। বিশেষত সেচ দফতরে দুর্নীতির যে অভিযোগটি বিরোধীরা আনিয়াছেন, মুখ্যমন্ত্রীকে লিখিত একটি চিঠিই তাহার ভিত্তি। তাহাতে ঠিকাদারদের একটি সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছে যে, ঠিকাদারের গুণগত মান বিচার না করিয়া বাঁধ প্রভৃতি নির্মাণের বরাত দেওয়া হইতেছে। বিষয়টি রাজ্যবাসীর নিকট যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। অভিযোগের সত্যতা নির্ণয় ‘অবান্তর’ বা ‘গুরুত্বহীন’ হইল কী হিসাবে?
হয়তো অস্বস্তি এড়াইতে সেচমন্ত্রী প্রশাসনিক প্রশ্নের উত্তর দিলেন রাজনীতির ভাষায়। কিন্তু তাঁহার স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হইবে না। দুর্নীতির অভিযোগ ইতিমধ্যেই শাসকদলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হইয়া উঠিয়াছে। দুর্নীতিগ্রস্তদের ‘শিক্ষা’ দিবার নামে বিরোধীদের একাংশ যে তাণ্ডব শুরু করিয়াছে, তাহা নূতন সঙ্কটের জন্ম দিয়াছে। এই হিংসা-বিধ্বস্ত, অশান্ত পরিস্থিতির দায় শাসক দল এড়াইতে পারে না। বিধিসম্মত উপায়ে প্রশ্ন করিলে যদি উত্তর না মেলে, তবে বিধি-বহির্ভূত উপায়ে রুদ্ধ ক্ষোভ প্রকাশ পাইতে চায়। শাসককে নাগরিকের স্বার্থেই বিরোধীকে সম্মান করিবার অভ্যাসটি রপ্ত করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy