সম্প্রতি সংসদে পাশ হওয়া তিনটি কৃষিবিলকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে তুমুল আলোড়ন ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দু’টি প্রশ্ন মাথায় আসে। এক, কেন দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ছোট কৃষকদের পরিবর্তে পঞ্জাব ও হরিয়ানার অপেক্ষাকৃত বড় কৃষকরা বিলটির প্রতিবাদে সরব হয়েছেন? দুই, কৃষক এবং কৃষির সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য মানুষ কী ভাবে বিলগুলির দ্বারা প্রভাবিত হবেন?
প্রথম বিলটি কৃষিপণ্যে মুক্ত বাণিজ্য সম্পর্কিত। এই বিল কার্যকর হলে কৃষক মান্ডির বাইরেও তাঁর পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। দ্বিতীয় বিলটি কৃষককে চুক্তিনির্ভর চাষে সাহায্য করবে। বীজ বপনের আগে কৃষক নিজে খরিদ্দারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাঁর শস্যের জন্য একটি নির্দিষ্ট দাম নির্ণয় করতে পারবেন। যে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা কৃষকের সঙ্গে এই ধরনের চুক্তিতে আসতে পারবেন। তৃতীয় বিলটি বলছে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বেসরকারি সংস্থারাও কৃষিপণ্য মজুত করতে পারবে।
শাসক দল বলছে, বিলগুলি ভারতীয় কৃষির খোলনলচে বদলে কৃষকের অবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটাবে। খুচরো ব্যবসায় আসা বড় বেসরকারি কোম্পানিগুলো সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে ভোক্তাদের কাছে সরাসরি বিক্রি করতে পারবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের আর দরকার পড়বে না। বিপণনের সুবিধার্থে বড় সংস্থাগুলো তাদের আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর গুদামে পণ্য মজুত রাখতে পারবে বলে কৃষিপণ্য নষ্ট হওয়ার প্রবণতা কমবে। সবার উপরে, বেসরকারি সংস্থাগুলোর বৃহৎ লেনদেন খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও বিপণনের খরচ কমাবে। সব মিলিয়ে, ভারতীয় কৃষি আরও দক্ষ, বাজার-নির্ভর হয়ে উঠবে, যার সুফল পাবেন ভোক্তা ও কৃষকরা।
বিরোধীদের মতে, আইন চালু হলে বড় বড় সংস্থা বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ফেলবে। এবং, কৃষকদের কাছ থেকে নামমাত্র দামে পণ্য কিনে তারা চড়া দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করবে। দ্বিতীয়ত, অত্যাবশ্যক কৃষিপণ্য মজুত করে তারা কৃষিপণ্যের দাম নিয়ে ফাটকা খেলবে, যাতে ক্ষতি হবে সাধারণ মানুষের। এবং, সরকার যদি কৃষির বাজার ছেড়ে বেরিয়ে আসে, তা হলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, যা কৃষকদের কাছে বিমার কাজ করে, ব্যাপারটাই হয়তো আস্তে আস্তে উঠে যাবে। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে খাদ্যশস্য সংগ্রহ না করলে রেশন ব্যবস্থাটাও ভেঙে পড়বে। গরিব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা থাকবে না।
কর্পোরেটরা বাজারে ঢুকলেই কৃষক ও ভোক্তার সর্বনাশ হয়ে যাবে, এ যুক্তি মানা যায় না। দেশের পণ্যের বাজারগুলো তো কর্পোরেটরাই চালাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের বড় ক্ষতি হয়েছে, এমন প্রমাণ নেই। বরং টেলিকমিউনিকেশনের মতো কিছু ক্ষেত্রে কর্পোরেটরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নেমে পণ্যের দাম অবিশ্বাস্য কমিয়ে দিয়েছে। আসল কথাটা হল প্রতিযোগিতা। বাজারে যদি একটা কর্পোরেটের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকে, তা হলে সে ভোক্তাদের শোষণ করবেই। কিন্তু একাধিক কর্পোরেট নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নামলে ভোক্তাদের উপকার হবে।
দ্বিতীয়ত, মজুত করার অনুমতি থাকলেই মজুতদাররা লাগাম ছাড়া মজুত করবে, এটাও মনে করার কারণ নেই। মজুত করা পণ্য তাদের তো এক দিন না এক দিন বিক্রি করতে হবে। আর একসঙ্গে অনেকটা বিক্রি করতে গেলেই বাজারে দাম পড়ে যাবে, তখন মজুতদারেরই ক্ষতি। তা ছাড়া মজুত করার খরচও আছে। তাই অনেক দিন ধরে মজুত করে রেখে একটু একটু করে বিক্রি করাটাও লাভজনক নয়। লাগাম ছাড়া মজুতের ভয় ভিত্তিহীন।
কিন্তু, কৃষি বিল কার্যকর হলে সকলেরই লাভ, তা নয়। বস্তুত, সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যাটা বেশ বড়। চলতি ব্যবস্থায় কতিপয় বড় কৃষক, যারা খাদ্যশস্যের বড় ব্যবসায়ীও বটে, এপিএমসি-র অধীনে থাকা মান্ডি বা বাজারগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। বহু ক্ষেত্রে এঁদের স্থানীয় স্তরে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এঁদের সঙ্গে যে ফড়েরা আছেন, তাঁরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে শস্য সংগ্রহ করার পর মান্ডিতে এসে এই বড় কৃষক-ব্যবসায়ীদের কাছে সেটা বিক্রি করেন। ব্যবসায়ীরা আবার সেই শস্য বিক্রি করেন শহরে। ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে এই ব্যবস্থায় কৃষক ভাল দাম পান না। কৃষি বিল চালু হলে এবং একাধিক কর্পোরেট কৃষকের কাছ থেকে শস্য কেনার চেষ্টা করলে স্থানীয় স্তরে ফসল কেনার প্রতিযোগিতা বাড়বে। ভেঙে যাবে ব্যবসায়ীর একচেটিয়া আধিপত্য। কৃষক আগের থেকে বেশি দাম পাবেন। কিন্তু এর ফলে সবথেকে ক্ষতি হবে বড় ব্যবসায়ীর।
পঞ্জাব-হরিয়ানায় শুধু যে উৎপাদন বেশি তা-ই নয়, সেখানে কৃষকরা একসঙ্গে অনেকটা জমি নিয়ে চাষ করেন। তাই এখান থেকে শস্য সংগ্রহ কম খরচসাপেক্ষ। ফলে কর্পোরেটদের প্রথম লক্ষ্য পঞ্জাব-হরিয়ানাই হবে। এখানকার বড় কৃষকরা স্বাভাবিক কারণেই বিচলিত। তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে কৃষি জমি বহুবিভক্ত, ছড়ানো, সেখানে এলে কর্পোরেটদের পোষাবে না।
পঞ্জাব-হরিয়ানার বড় কৃষক-ব্যবসায়ীরাই যদি শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতেন, তা হলে কৃষকদের প্রতিবাদ এত বড় আন্দোলনের চেহারা নিত না। কৃষি বিল বড় কৃষক-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ওপর নির্ভরশীল লক্ষাধিক ছোট ও মাঝারি মধ্যস্বত্বভোগীর ভবিষ্যৎও ঘোর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ‘ফড়ে’, ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ ইত্যাদি শব্দ নিন্দাসূচক। কিন্তু যে দেশে উৎপাদন শিল্পের তেমন উন্নতি হয়নি, সেখানে এই কাজ করা ছাড়া বহু মানুষের সামনে আর কোনও বিকল্প আছে কি? তাই কিছুটা সহানুভূতি এঁরা দাবি করতেই পারেন। এঁরা ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় রয়েছেন অসংখ্য গ্রামের গরিব মানুষ, যাঁদের নিজের জমি নেই, যাঁদের শ্রম বিক্রি করে সেই টাকায় স্থানীয় বাজার থেকে খাদ্যশস্য কিনে পেট চালাতে হয়। কর্পোরেটরা আসার ফলে গ্রামের বাজারে যদি চাল-গম-আনাজের দাম বেড়ে যায়, এঁরা না খেয়ে মরবেন।
কৃষি বিল আসুক, কর্পোরেটরা তাদের নতুন প্রযুক্তি নিয়ে বাজারে প্রবেশ করুক, কিন্তু সেই অজুহাতে সরকার যেন সব দায়িত্ব এড়িয়ে কৃষি থেকে বেরিয়ে না যায়। ভারতে যেমন ছোট কৃষকের নিরাপত্তার প্রয়োজন, তেমনই জরুরি খাদ্য সুরক্ষাও।
অর্থনীতি বিভাগ, আইআইটি গুয়াহাটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy