আগুন নেভাতে ব্যস্ত দমকলকর্মীরা। নিজস্ব চিত্র
পুরুলিয়া জেলার যে অংশেই আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন, পাহাড় বা জঙ্গল আপনার চোখে পড়বেই। শীতে এই পাহাড়গুলিকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের ঢল নামে। আবার, বসন্তে পলাশে ঘেরা পাহাড়, জঙ্গল দেখতেও মানুষের অভাব হয় না। কিন্তু বিপদটা শুরু হয় তার পরেই। যখন সবুজ ঘাস শুকিয়ে হলুদ হয়, গাছ থেকে ঝরে পড়া শুকনো পাতা ছড়িয়ে থাকে চতুর্দিকে। সেই শুকনো পাতা ও ঘাসে আগুন লেগে ডেকে আনে বিপদের আশঙ্কা। প্রায় ফি বছরই এই সমস্যায় এক দিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাহাড়কে ঘিরে থাকা গাছগাছালি ও পশুপাখি, তেমনই প্রভাবিত হয় পাহাড় সংলগ্ন জনবসতিও।
জঙ্গলে আগুন লাগার রূপ কতটা ভয়ানক হতে পারে, আমাজন ও অস্ট্রেলিয়ার সেই স্মৃতি এখনও টাটকা। এক দিকে বিস্তীর্ণ এলাকার সবুজের ধ্বংসসাধন, অজস্র বন্যপ্রাণীর মৃত্যু, অন্য দিকে আগুন নেভাতে গিয়ে দমকলকর্মীদের হিমশিম অবস্থা। অনেকে মনে করেন, এই অগ্নিকাণ্ডের পেছনে যেমন প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে, তেমনই রয়েছে অন্তর্ঘাতও।
চলতি বছরে এপ্রিলের শুরুতে বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পাহাড়, মুকুটমণিপুরে আগুন লাগে। শুশুনিয়া পাহাড়ে বিশাল অংশ জুড়ে রাতে আগুন লাগার দৃশ্য সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে সবাই দেখেছেন। আগুন লাগতেই পাহাড় থেকে নেমে এসেছিল প্রচুর বাঁদর। তবে আগুনে অনেক প্রাণীই ঝলসেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। ঠিক এই সময়েই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে রঘুনাথপুরের জয়চণ্ডী পাহাড় এবং সাঁতুড়ি ব্লকের বড়ন্তির দন্ডহিত পাহাড়ের জঙ্গলেও।
পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর মহকুমার গড়পঞ্চকোটের পাহাড়ি এলাকা এবং সাঁতুড়ির বড়ন্তি-সহ বিস্তৃর্ণ বনভূমি বন দফতরের অধীনে। রঘুনাথপুরের জয়চণ্ডী পাহাড় রয়েছে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের হাতে। বন দফতরের তথ্য অনুযায়ী, পঞ্চকোট পাহাড়ে প্রায় ১৪০০ হেক্টর এবং সাঁতুড়িতে পাহাড় ও জঙ্গল মিলি প্রায় ৭০০ হেক্টরের মতো জমি দফতরের অধীনস্থ। আর জয়চণ্ডী পাহাড় এলাকায় প্রায় ৬০-৭০ হেক্টর রয়েছে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের হাতে। তিনটি পাহাড়ি এলাকাতেই উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্রের তুলনা হয় না। হায়েনা, শেয়াল, পিপীলিকাভুক, বড়ছোট বিষযুক্ত ও বিষহীন সাপ, খরগোস, শজারু, বুনো শুয়োরের মতো নানা প্রাণীর দেখা মেলে এই এলাকাগুলিতে। সাঁতুড়ির দন্ডহিতে বন দফতরের উদ্যোগে রাখা রয়েছে প্রায় শতাধিক হরিণ। তাই কোনও ভাবে এই এলাকায় আগুন লাগলে তা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। জীবন্ত অবস্থায় দগ্ধ হতে পারে শয়ে শয়ে বন্যপ্রাণী। সেই সঙ্গে ধ্বংস হবে বিশাল অংশের গাছগাছালিও। তবে ক্ষতির খতিয়ান এখানেই শেষ হবে না। এ সব পাহাড়ি এলাকা লাগোয়া অংশে অনেক জনবসতিও আছে। বিশেষত রঘুনাথপুর পুরশহরের নন্দুয়াড়া এলাকার একটি অংশ জয়চণ্ডী পাহাড়ের কোলেই অবস্থিত। জঙ্গলে আগুনের আতঙ্কে তাই ভীত স্থানীয় বাসিন্দারাও।
অন্য সমস্যাও আছে। শুকনো আবহাওয়ায় জঙ্গলে যেহেতু প্রায়ই আগুন লাগে, তাই দমকলও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তারা দ্রুত পদক্ষেপ করেন। তবে জঙ্গলের আগুন আয়ত্তে আনা সহজ নয়। এপ্রিলের প্রথমে সাঁতুড়ির দণ্ডহিত এলাকা এবং জয়চণ্ডী পাহাড়ে আগুন নেভাতে দমকলকে বেগ পেতে হয়। কারণ, পাহাড়ের কাছাকাছি একটু নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্তই দমকলের গাড়ি নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। দণ্ডহিতে আগুন উপরে থেকে নীচে নেমে আসার ফলে দমকলের পক্ষে সেই জায়গায় গিয়ে আগুন নিভিয়ে আসতে সমস্যা হয়েছিল।
এ বছরে রঘুনাথপুরের জয়চণ্ডী পাহাড়েও পরপর তিন দিন ঘটে অগ্নিকাণ্ড। জয়চণ্ডী পাহাড় এলাকায় রয়েছে কালীপাহাড়-সহ আরও ৪-৫টি ছোটবড় পাহাড়। এখানে আগুনের ঘটনা প্রথমে নজরে আসে রঘুনাথপুর কলেজের পেছনের অংশে। খবর পেয়ে দমকল সেখানে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। আগুন নেভানোর কাজে হাত লাগান অন্যেরাও। সে দিনের মতো আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। পরের দিন আবার আগুন লাগলেও আধ ঘণ্টার চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনে দমকল। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তৃতীয় দিনে। জয়চণ্ডী পাহাড় সংলগ্ন কালীপাহাড়ের উপরের অংশে আগুন লাগে। পাহাড়ের নীচেই রয়েছে নন্দুয়াড়ার বাগদিপাড়া এলাকা। সরু গলিপথে পাহাড়ের কাছে বেশি দূর দমকলের গাড়ি এগোতে পারেনি। সীমিত দূরত্বে থেকেই তৎপরতার সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হয়। তবে সমস্যা শুধু আগুন লাগার জায়গায় পৌঁছনোয় নয়, জলের পাইপও উপরে নিয়ে যাওয়ার সময়ে তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
ঠিক কী কারণে এই অগ্নিকাণ্ড, তা নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের মত, অনেকে বিনা কারণে শুকিয়ে যাওয়া ঘাস-পাতায় আগুন ধরিয়ে দেন। আবার অনেক ধূমপায়ী বিড়ি বা সিগারেট না নিভিয়ে যত্রতত্র ফেলে দেন, যা থেকে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, শুধু গরমের শুরুতেই নয় বা শুকিয়ে ঘাস বা পাতার ফলেই নয়, জয়চণ্ডী পাহাড়, বড়ন্তি ও গড়পঞ্চকোটের পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের অসাবধানতাতেও অনেক সময়ে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। যদিও প্রশাসনিক তৎপরতায় সে সব এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে
জঙ্গলে আগুন লাগলে শুধু বনস্পতি বা বন্যপ্রাণীই নয়, লাগোয়া এলাকার জনজীবনও বিপর্যস্ত হয়। প্রাকৃতিক ভাবে আগুন লাগা হয়ত ঠেকানো সম্ভব নয়, কিন্তু তা কী ভাবে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তার জন্য নির্দিষ্ট ও কার্যকরী রূপরেখা তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। না হলে আরও একটা আমাজন বা অস্ট্রেলিয়ার মতো বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে হবে আমাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy