নৈতিকতার ধ্রুপদী আলোচনায় ‘নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক’ নামক ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এমন এক জন ‘র্যাশনাল’ বা সম্পূর্ণ যুক্তিনিষ্ঠ ব্যক্তি, প্রাসঙ্গিক তর্কে যাঁহার কোনও স্বার্থ নাই, কিন্তু দুই পক্ষের অবস্থান, যুক্তি এবং উদ্দেশ্য বিষয়ে সম্যক ধারণা আছে। কোনও সিদ্ধান্তের নৈতিকতা নির্ধারিত হয় এই নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের অনুমোদনের সাপেক্ষে। দর্শনের তত্ত্বের ধারণা যে অবিকল বাস্তবের কোনও মানুষের রূপ পরিগ্রহ করিতে পারে না, তাহা সত্য। কিন্তু, নৈতিকতার বিচারে সেই পর্যবেক্ষকের গুরুত্ব তাহাতে খর্ব হয় না। বরং, সমাজকে যদি নৈতিকতায় স্থিত হইতে হয়, তবে খণ্ডিত রূপে হইলেও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক প্রস্তুত করিয়া লওয়া বিধেয়। বহু ক্ষেত্রেই সেই গুরুদায়িত্ব বহন করিতে পারে নাগরিক সমাজ। অর্থাৎ, সমাজের যে অংশটি শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত, যুক্তিদ্বারা পরিচালিত। তাঁহারা প্রশ্ন করিতেই পারেন, ‘নিরপেক্ষ’ হইব কেন, আমরা তো এই সমাজের অভ্যন্তরীণ— আমাদের প্রতিটি ব্যক্তি প্রতিটি প্রশ্নেই কোনও একটি পক্ষের অন্তর্গত। নিরপেক্ষতার দাবি আমরা মিটাইব কেন? আপত্তিটি অসঙ্গত নহে। কিন্তু, অমর্ত্য সেন বলিবেন, ব্যক্তি নহেন, পক্ষের অন্তর্গত তাঁহার কোনও একটি সত্তা, কোনও একটি পরিচিতি। প্রতিটি ব্যক্তিই বহুবিধ পরিচিতির সমাহার, অতএব যে পরিচিতিটি কোনও একটি বিরোধের কেন্দ্রে কোনও একটি পক্ষের সহিত একাত্ম বোধ করে, তাহাকে বাদ রাখিলে অন্য পরিচিতিগুলির পক্ষে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করা সম্ভব। অনুশীলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষতাকে আত্মস্থ করিবার কাজটি নাগরিক সমাজ না করিলে ঘোর বিপদ।
সেই বিপদ কোথায়, তাহা প্রশ্নাতীত রকম স্পষ্ট। সাম্প্রতিক ভারত বা পশ্চিমবঙ্গকে দেখিয়া, অথবা নিতান্তই নিজস্ব প্রতিবেশকে দেখিয়া, বাংলা কবিতার পাঠকের হয়তো সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘উটপাখী’ কবিতাটির কথা মনে পড়িতেছে। ‘অখিল ক্ষুধায়’ নিজেই নিজেকে ভক্ষণ করা ঠিক কাহাকে বলে, দিগন্তে মরীচিকাটুকুও না থাকিবার নৈরাশ্য ঠিক কতখানি তীব্র, এই সময় তাহা মর্মে মর্মে বুঝাইয়া দিতেছে। এই সমাজ সংঘাতের অক্ষরেখায় বিভক্ত। কার্যত প্রতিটি প্রশ্নে। গণতন্ত্র প্রশ্নহীন ঐকমত্যের দাবি করে না, তাহা অনস্বীকার্য— বিতর্কে, বিরোধেই গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যরক্ষা হয়। কিন্তু ভারতের বা পশ্চিমবঙ্গের সমাজে যাহা চলিতেছে, তাহা যুদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই যুদ্ধে দুই পক্ষে দাঁড়াইয়া যুযুধান রাজনৈতিক দল। সেই দলের নেতৃবর্গ। কিন্তু, শুধু সেনাপতিতে যুদ্ধ চলে না। তাহার জন্য পদাতিক প্রয়োজন। যে কোনও বিরোধে ভারতের সমাজ শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক পরিচিতিটুকুকে কেন্দ্র করিয়া আড়াআড়ি ভাঙিয়া যাইতেছে। সামাজিক পরিসরে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নাগরিক সমাজ হইয়া উঠিতেছে রাজনৈতিক যুদ্ধের বোড়ে। যাবতীয় শিক্ষা, যুক্তিবোধ বিসর্জন দিয়া হইয়া উঠিতেছে প্রতিপক্ষের নিধনকামী পদাতিক। যে লড়াই মূলগত ভাবে দলীয় অথবা খণ্ডস্বার্থের, তাহা হইয়া দাঁড়াইতেছে পরিচিতির নির্বিকল্প ধর্মযুদ্ধ। এবং, প্রতি দিন তাহা সমাজের কষ্টার্জিত শিষ্টতার প্রলেপ ভেদ করিয়া প্রকাশ করিতেছে এক আদিম রূপ— যে আদিমতায় শিষ্টতা গণ্য হয় শুধুমাত্র পরিহার্য দুর্বলতা রূপে। এই ধ্বংসের দায়ভাগে নাগরিক সমাজের যুযুধান দুই পক্ষই সমান ভাবে দায়ী। প্রতিটি প্রশ্নে।
নাগরিকের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের ভূমিকা এই লড়াইগুলিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করিতে পারিত। শুধু এই কারণে নহে যে সে ক্ষেত্রে লড়াইয়ের ময়দানে পদাতিকের ঘোর অভাব ঘটিত। এই কারণেও বটে যে তখন যুদ্ধের সেনাপতিরা জানিতেন, তাঁহাদের প্রতিটি পদক্ষেপের নিরপেক্ষ বিচার চলিতেছে। সেই বিচার গোষ্ঠীস্বার্থের মাপকাঠিতে নহে, বরং নৈতিকতার মানদণ্ডে। নৈতিকতা বস্তুটিও নিরালম্ব নহে। ভারতের ক্ষেত্রে সেই নৈতিকতাকে দেশের সাংবিধানিক চরিত্রের সমানুবর্তী হইতে হইবে। নেতারা জানিতেন, তাঁহারা সংখ্যালঘুদের চাপে রাখিতে পারিলেই সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন মিলিবে না, বরং সেই চাপে রাখা যে প্রবল অন্যায়, সেই কথাটি নাগরিক সমাজের আদালতে দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রমাণ হইয়া যাইবে। নেতারা জানিতেন, চিকিৎসকদের ধর্মঘট গরিব মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী বলিলেই বৃহত্তর জনসমাজের মন বিষাইয়া দেওয়া যাইবে না, কেন তাঁহারা এ হেন ধর্মঘটের পথে হাঁটিতে বাধ্য হইলেন, সেই প্রশ্নের জবাবদিহি করিতে হইবে। নাগরিকের প্রশ্নহীন আনুগত্য নহে, বরং সপ্রশ্ন বিচারই নেতাদের, দলগুলিকে সংযত করিত। তাঁহাদের গণতন্ত্রের সমীপবর্তী করিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy