বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে গেরুয়া শিবিরে যোগদান করার একটি প্রবণতা দেখা দিয়েছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে আজ অবধি, রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, সংস্কৃতি জগতের কিছু লোকও পা বাড়াচ্ছেন। কেউ কেউ আবার সবিস্তারে বলার চেষ্টা করেছেন যে— তিনি বা তাঁরা ‘মানুষের জন্যে কাজ’ করতে চান বলেই ও পথে পাড়ি দিচ্ছেন। এ সব পড়ে এবং শুনে কিছু কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে।
লক্ষণীয়, এঁরা কেউই কিন্তু বর্তমান শাসক দলের উপর রাগ থেকে ভুলেও বামের দিকে পা বাড়াচ্ছেন না! এঁদের মধ্যে কেউ কেউ এক সময়ে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতি করে থাকলেও এঁদের এখন মনে হচ্ছে বামফ্রন্ট এক সুপ্রাচীন ফসিলে পরিণত হয়েছে। হয়তো ঠিক কথা। কিন্তু যদি সত্যিই এক দিন বাম রাজনীতি করে থাকেন, তা হলে আজ অতি-দক্ষিণপন্থী দলে যোগ দিতে সমস্যা হচ্ছে না এঁদের? পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস তো প্রমাণ করে যে, এরা একে অন্যের সবচেয়ে বড় শত্রু! মধ্যপন্থীরা যুদ্ধের পদাতিক সৈন্যমাত্র। বামপন্থী থাকতে চাইলে কেবল সিপিএম-এ যোগ দিতে হবে কেন, অন্য অনেক ভাবেই থাকা যায়। অবশ্য যদি না ‘বামপন্থায় বিশ্বাস’ ব্যাপারটা শুধুমাত্র দলীয় রাজনীতি, ক্ষমতার লড়াই এবং প্রাতিষ্ঠানিকতার উপর নির্ভর করে!
এঁদের কেউ কেউ আবার সিপিএম থেকে সরে এসে এত দিন তৃণমূলের সঙ্গে ছিলেন। এ বার ভাবছেন আর একটু দক্ষিণে হাঁটবেন। এঁরা দাবি করেছেন, ২০১৪-র লোকসভা ও ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের সময় এঁরা খুবই পরিশ্রম করেছেন তাঁদের সেই সময়কার দলের হয়ে। বদলে কেউ পেয়েছেন মন্ত্রিত্ব, কেউ সরকারি বা সাংগঠনিক পদ, এবং লালবাতি গাড়ি। কেউ কেউ তো তাঁদের নিজের অঞ্চলে মিনি-সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন। হঠাৎ ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের বছরখানেক আগে থেকে, যখন রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতা বৃদ্ধি শুরু করে, সেই সময় থেকে এঁদের মনে হয়েছে, এঁরা বঞ্চিত, অপমানিত, এঁদের কাজ করতে দেওয়া হয়নি।
যেটা আশ্চর্যের সেটা হল, তৃণমূলের বেশির ভাগ সমস্যাগুলির উৎপত্তি এবং বিকাশ কিন্তু তাদের প্রথম পাঁচ বছরেই; স্থানীয় স্তরে দুর্নীতি, সিন্ডিকেট রাজ, সারদা, নারদ, সব। বরং এই সরকারের যে উল্লেখযোগ্য ভাল কাজ, মানবদরদি প্রকল্প, মৌলিক পরিকাঠামো উন্নতির চেষ্টা (এবং সাফল্য, আংশিক হলেও), সেগুলির অধিকাংশই ঘটেছে গত পাঁচ বছরে। তা হলে এই দলতন্ত্রীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হওয়ার টাইমিং-টা ২০১৫ বা ২০১৬-তে না হয়ে ১৯-২০’তে হল কেন?
তা হলে কি তদানীন্তন তৃণমূলের এই সদস্যদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাগী বাঘগুলো বেরিয়ে এল এই সুযোগে? আরও ক্ষমতার হাতছানি এবং আইটি সেল-এর ফেক ভিডিয়ো বা থিয়োরি প্রচারের দৌলতে? না কি ব্যাপারগুলো আরও ‘উচ্চতর’ চাওয়া-পাওয়ার হিসেব-কেন্দ্রিক?
বেশ, তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম যে এঁরা গত তিন-চার বছরে বেশি করে শ্বাসরুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু পাশাপাশি, গত কয়েক বছরে বিরোধী কথা বলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর যে হামলা চলেছে, বিরোধী নাগরিক কণ্ঠ যে ইউএপিএ দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে, আদালত, সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কমিশন, সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা যে ভাবে ভাঙা হয়েছে, অর্থনীতির মহাসঙ্কট ডেকে আনা হয়েছে— কোনওটাই প্রাক্তন বামপন্থীদের বা আমার সহকর্মীদের ‘রাগ’ করার তেমন কারণ জোগাচ্ছে না দেখলাম। বরং বিজেপি কেন ‘অচ্ছুত’ নয়, দেখছি সেটাই বিশদে বোঝাতে বসেছেন তাঁরা। না, নতুন কোনও দৃষ্টিভঙ্গি পেলাম না, তাঁরা বিজেপি শিবিরের সেই শেখানো ‘ন্যারেটিভ’টাই আওড়াচ্ছেন।
যেমন, সিএএ নাকি আসলে নাগরিকত্ব ‘দেওয়া’র আইন, ‘নেওয়া’র নয়। সবাইকে নাকি ভুল বোঝানো হচ্ছে। ধরেই নিচ্ছি, এঁরা সবাই এ দেশের নাগরিকত্ব আইন-এর গোড়া, ১৯৫৫-র এবং ২০০৩-এর সংশোধনী সম্পর্কে যথেষ্ট জানেন! প্রশ্ন হল, সিএএ যদি নাগরিকত্ব ‘দেওয়া’র আইনই হয়, তবে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের সীমারেখাটা কেন? পড়শি দেশে তার পর কি সংখ্যালঘুর অত্যাচার বন্ধ হয়ে গিয়েছে? শুধু হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈনরাই বা কেন? পড়শি দেশের নিপীড়িত আহমদি, শিয়া, রোহিঙ্গা, সেকুলার মুসলিমরা বাদ কেন?
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ক্রোনোলজি’ সমঝেই বলছি, এনআরসি ছাড়া সিএএ একটি কাগজের পাতা মাত্র। এনআরসি করতে গিয়ে কিন্তু মুসলমানদের মতোই বিপদে পড়েছেন হিন্দুরা। কারণ যে কাগজ দেখিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে বাইরে থেকে আসা মানুষরা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এ দেশে পা দিয়েছেন, প্রমাণ করতে হবে কবে পা দিয়েছেন, সেই কাগজ থাকা অসম্ভব। অসমে তা প্রমাণ হয়েছে— লক্ষ লক্ষ হিন্দু কাগজ দেখাতে পারেননি। অথচ তাঁদের অধিকাংশেরই রেশন কার্ড বা আধার কার্ড, এমনকি পাসপোর্টও আছে। তাঁরা ভোটারও বটে! আজ তাঁরা হঠাৎ নাগরিকত্ব প্রমাণের পরীক্ষায় বসবেন? এত দিন কি বিদেশিদের ভোটে চলে এসেছে এই সার্বভৌম রাষ্ট্র? সেই ভোট তো তা হলে খারিজ করতে হয়। সরকারকেও খারিজ করতে হয়!
ভারতীয় সংবিধানের অন্তত সাতটি ধারা লঙ্ঘন করছে এই সিএএ। এই উপমহাদেশের ভঙ্গুর ইতিহাস, উদ্বাস্তু মানুষের করুণ অসহায়তা আজ যদি ভুলেও যাই, এই সহজ পাটিগণিত কিংবা সংবিধানকে ভুলব কী করে?
আরও দু’-একটা কথা। ধর্মনিরপেক্ষতার দায়িত্ব সেই সমাজ ও সেই মানুষগুলির কাঁধেই থাকে যারা সংখ্যায় বা জোরে বেশি— সভ্যতা আমাদের এটাই শিখিয়েছে। ঠিক সেই কারণেই পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অন্যায় হলে সেই দায়িত্ব সেখানকার মুসলমানদেরই নিতে হবে, কারণ তাঁরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ঠিক সেই কারণেই বাংলাদেশে জামাত-ই-ইসলামি’র মতো উগ্রবাদী সংগঠনের ক্ষমতা বাড়লে আমরা চিন্তিত হই। যেখানে যখন নানা বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনও রাজনৈতিক দল ‘সংখ্যাগরিষ্ঠরা বিপদে’ বলে জিগির তোলে, সেখানেই ক্রমে সংখ্যালঘুদের ন্যূনতম অধিকার, অস্তিত্ব কেড়ে নেওয়া হয়, এবং তার পর তা গণনিধন বা জেনোসাইডের দিকে যায়। এ সবই আমরা জানি। কিন্তু আমাদের নিজেদের দেশে যখন উগ্র সংখ্যাগুরুবাদ ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আমরা ব্যস্ত থাকি শুধুই কে চাল চুরি করল, কে ক্ষমতা বেশি নিয়ে নিল ইত্যাদি নিয়ে। পড়শি দেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার ফলাও করে প্রচার করা হয়, কিন্তু সেই একই আঙুল নিজেদের দিকে ওঠে না কিছুতেই।
বাংলাদেশের কিছু গ্রামে হিন্দুদের উপর অন্যায়ের কথা বলেন এ দেশের অতি-দক্ষিণপন্থীরা। সেই অন্যায় অতীব নিন্দনীয়। কিন্তু ও দেশে যে প্রতি বছর ৩০,০০০ দুর্গাপুজো হয়, কিংবা সেখানে মুসলমানরাই যে ইসলামি উগ্রপন্থার বিরোধ করে চলেছেন বরাবর, এ সব কথা তাঁরা বলেন না। কারণ এ সব তাঁদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে না।
মোদ্দা কথা হল— বিজেপি-তে যাওয়ার হলে এমনিই যান, গটগট করে যান! এত সাফাই গাওয়ার বা পিছুটানে ভোগার দরকার নেই! সেটা করলেই বরং এতগুলো প্রশ্ন উঠে আসে। এই দোনামোনা, এই ‘না, মানে ভাবছি, সিদ্ধান্ত নেব’— এ সব কেন? নাড়ি টিপে বা না টিপে এটুকু বুঝতে পারি যে, যাঁদের জন্যে এত ‘এক্সপ্ল্যানেশন’ দিচ্ছেন, তাঁরা, আমাদের দেশের মানুষের একটা বড় অংশ, কিন্তু সুন্দর করে বুঝে গিয়েছেন যে— বর্তমান রাজনীতি শুধু ক্ষমতা, গুরুত্ব আর প্রতিপত্তির খেলা। তাঁরা দেখে রাখেন সবই (এবং জায়গামতো নিজেদের মতটা পেশও করেন, আজও)। তাঁরা কিন্তু এই বদলাবদলি নিয়ে অত উত্তেজিত হন না। আপনারাও হবেন না! চিল, ব্রো! আমরা এখন শুধু অন্ধের মধ্যে ঝাপসা খুঁজছি, যাকে বলে ‘চুজ়িং দ্য লেসার ইভল’। আমি আমারটা খুঁজে নিয়েছি, আপনারাও খুঁজুন! ২০২১ সালে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তো হয়েই গেল, আর যদি না আসে, তখনও হয়তো আপনাদের ‘এ ভাবেও ফিরে আসা যায়’ গাইতে গাইতে ফিরতে হবে।
যে মেরুকরণের রাজনীতি বর্তমানে ভারতের সমাজে টিকা দেওয়ার মতো করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় সবটাই বিপজ্জনক এবং ক্ষতিকারক, বলাই বাহুল্য। কিন্তু এটার ভাল দিকও আছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কে আসলে কী, কার ভিতরে কী, সেটা খোলসা হয়ে যাচ্ছে এই বাজারে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, আমাদের দেশ এমন ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বিশ্বাসের জন্যে প্রয়োজনে সম্পর্ক বিসর্জন দেওয়া যায়। অবশ্যই সৌজন্য, কাজের সমাদর বা পেশাদারিত্ব বজায় থাকবে। কিন্তু ওইটুকুই।
আসলে সংসদীয় বা দলীয় ছাড়াও ‘পলিটিক্স’ কথাটার আরও একটা অর্থ আছে। ব্যক্তিগত দর্শন বা বিশ্বাসটাই আসল পলিটিক্স। এর সঙ্গে তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম-এর কোনও সম্পর্ক নেই! এই পলিটিক্স-টা জোরদার হলে কোনও দিন দলীয় রাজনীতি থেকে ভাত, রুটি, নলেন গুড় বা দধিকর্ম, কোনওটাই খেতে হয় না। আমার খেতে হয়নি। তাই মুক্তির শ্বাস নিয়ে বলতে পারি, ‘মানুষের জন্যে কাজ’ করতে হলে দলীয় রাজনীতি করার দরকার হয় না।
ভয় আমারও করে, দর্শক ভাগ হওয়ার ভয়, আইটি সেল-এর কুৎসিত অপমানের ভয়।
কিন্তু এর চেয়ে আরও বড় ভয়— বাঙালি হিসেবে, ভারতীয় হিসেবে, কিছু বিশ্বাস থেকে সরে গেলে যদি রাতে ঘুম না আসে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy