Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

সভ্যতার কণ্ঠস্বর

অদ্বৈতবাদীরা ব্রিটিশ রাজনীতিকদের কথাবার্তা শুনিয়া খুশি হইবেন না। অদ্বৈতবাদ বলিতে আধ্যাত্মিকতার কথা হইতেছে না, হইতেছে আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা পরিচিতির রাজনীতির কথা।

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

অদ্বৈতবাদীরা ব্রিটিশ রাজনীতিকদের কথাবার্তা শুনিয়া খুশি হইবেন না। অদ্বৈতবাদ বলিতে আধ্যাত্মিকতার কথা হইতেছে না, হইতেছে আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা পরিচিতির রাজনীতির কথা। সেই রাজনীতি ব্যক্তিকে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, দেশ, রাজ্য, ভাষা, ইত্যাদি বিভিন্ন মাত্রার কোনও একটিতে আবদ্ধ রাখিতে চাহে। এই একমাত্রিক পরিচিতির বিপদ সম্পর্কে উদারপন্থার প্রবক্তারা সতর্ক করিয়াছেন। যেমন, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন দেখাইয়াছেন, একত্ববাদ (সলিটারিজ়ম) কী ভাবে হিংসা তথা হিংস্রতাকে মারাত্মক শক্তি দেয়। এই মাত্রাটি সচরাচর সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, যখন তাহা অতিজাতীয়তাকে কেন্দ্র করিয়া তৈয়ারি হয় এবং রাষ্ট্রশক্তি ব্যক্তিকে তাহার নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করিতে বলে। যে সেই নির্দেশ অমান্য করে, রাষ্ট্রের চোখে সে দেশদ্রোহী, সুতরাং দমনীয়।

ব্রিটিশ রাজনীতিকদের একাংশ এই একমাত্রিক পরিচিতির ধারণাকে অস্বীকার করিয়াছেন। যেমন কনজ়ার্ভেটিভ দলের প্রবীণ ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জেমস ক্লেভারলির বক্তব্য: কোনও নাগরিক একই সঙ্গে ব্রিটিশ এবং ভারতীয় হিসাবে গর্বিত বোধ করিতেই পারেন। হাউস অব লর্ডস-এর সদস্য লর্ড গাডিয়ার অভিমত: অভিবাসী মানুষকে তাঁহার বাসভূমিকেই আপন পরিচিতির নিরঙ্কুশ নির্ণায়ক হিসাবে বাছিতে হইবে, এমন নির্দেশ আজ অচল, কারণ মানুষ এখন বহু(মাত্রিক) পরিচিতিতেই স্বচ্ছন্দ। অতীতে কনজ়ার্ভেটিভ রাজনীতিক নর্মান টেবিট বলিয়াছিলেন, জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ পরিত্যাগ না করিলে কোনও বহিরাগত ‘যথার্থ’ ব্রিটিশ হইতে পারেন না। তিনি খাঁটি ব্রিটিশত্ব যাচাইয়ের পরীক্ষাও উদ্ভাবন করেন, তাহা টেবিট টেস্ট নামে

(কু)খ্যাত হয়। ইহা সন্ন্যাসীর পূর্বাশ্রম ত্যাগের মতোই, পুনর্জন্মের শামিল। স্পষ্টতই, লর্ড গাডিয়া বা জেমস ক্লেভারলি নর্মান টেবিটের বিপরীত কথা বলিতেছেন। বহুত্বের কথা।

এই উদার বহুত্বের কথা নিশ্চয়ই ব্রিটিশ রাজনীতি তথা সমাজের সামগ্রিক মত নহে। বস্তুত, ব্রেক্সিট-তাড়িত ব্রিটেনে সঙ্কীর্ণ একমাত্রিক পরিচিতির দাবি জোরদার। কিন্তু ‘রক্ষণশীল’ রাজনীতিকদের এই অবস্থান জানাইয়া দেয়, দেশটি দীর্ঘকাল ‘মাল্টিকালচারালিজ়ম’ বা বহুসংস্কৃতিবাদের যে অনুশীলন করিয়াছে, সঙ্কীর্ণ একমাত্রিকতার অভিঘাতে তাহার শক্তি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় নাই। তাৎপর্যপূর্ণ যে, রাজনীতিকরা উপরোক্ত কথাগুলি বলিয়াছেন ব্রিটেনে আয়োজিত বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে। এই প্রতিযোগিতায় ভারত পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার দাপট, দর্শকদের বিরাট অংশও ভারতীয় উপমহাদেশ হইতে উদ্ভূত অভিবাসী। টিকিটের চাহিদা ও বিক্রয়ের পরিসংখ্যানেও তাঁহাদের প্রবল উপস্থিতি। অনেকেই বিভিন্ন খেলায় আপন আপন উৎস-দেশের দলকেই সমর্থন করিবেন। সংবেদনশীল রাজনীতিকরা বলিতেছেন, ইহার সহিত তাঁহাদের ব্রিটিশ নাগরিকত্বের কিছুমাত্র বিরোধ নাই— ক্রীড়ামোদী দর্শক-সত্তাটিও অন্যতম স্বীকৃত সত্তা, তাহার সহিত নাগরিকত্বের জাতিরাষ্ট্র-পরিচয়কে মিশাইলে চলিবে কেন? ইহাই সভ্যতার কণ্ঠস্বর। পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অংশে এই কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইতে হইতে আজ কার্যত রুদ্ধ হইতে বসিয়াছে। বিশেষ উদ্বেগের কথা।

অন্য বিষয়গুলি:

Britain Politics Solitarism Brexit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy