বই কি কখনও মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলিতে পারে? জড়পদার্থ বই পারে না। কিন্তু মানব-বই পারে। বস্তুত, কথা বলে বলিয়াই সে বই হইয়া উঠিতে পারে। তাহার শরীরে শুধুমাত্র কিছু পাতা আর অন্যের লেখা অসংখ্য অক্ষর নাই। তাহার আছে একটি নাম, সমাজের চোখে একটি পরিচয় এবং জীবনের কিছু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতাই সে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করিয়া লইতে চাহে। মানব-বইরা সমাজের বিভিন্ন কোণ হইতে উঠিয়া আসা কিছু মানুষ। তাঁহাদের মধ্যে কেহ দৃষ্টিহীন, কেহ একা মা, কেহ আবার শৈশবেই যৌন হেনস্থার শিকার। সমাজ তাঁহাদের এই দাগ-সমেতই চিনিতে শিখিয়াছে, এবং সেই চোখেই অন্যদের তুলনায় আলাদা করিয়া দেখিতে অভ্যস্ত হইয়াছে। তাই মানব-বই তাহার এই বিশেষ পরিচয় এবং পরিচয়ের সঙ্গে লাগিয়া থাকা কিছু প্রচলিত ‘ধারণা’কেও বদলাইতে চাহে। সর্বোপরি, ভিন্ন পটভূমি হইতে উঠিয়া আসা মানুষদের সঙ্গে কথা বলিয়া নিঃসঙ্কোচে কিছু মুহূর্ত কাটাইতে চাহে। বিভিন্ন মানুষের মধ্যে আদানপ্রদানের এই ধারণাটি লইয়াই মানব-গ্রন্থাগারের প্রথম যাত্রা শুরু আঠারো বৎসর পূর্বে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহাগেনে। এই দেশেও ইনদওর, হায়দরাবাদে মানব-গ্রন্থাগার স্থাপিত হইয়াছে, অন্য শহরেও তাহার শাখাপ্রশাখা বিস্তারের পরিকল্পনা। উদ্দেশ্য, তর্কের মধ্য দিয়া নহে, বরং গ্রন্থাগারের উপযুক্ত আলোচনার পরিবেশে একে অন্যকে বুঝিবার চেষ্টা করা। অন্যকে বুঝিতে হইলে সর্বাগ্রে তাহার কথা শুনিতে হয়। সেই শুনিবার অভ্যাসটি তৈয়ারি করাও মানব গ্রন্থাগারের লক্ষ্য।
এবং এই কারণেই এমন উদ্যোগের বড় প্রয়োজন। বিশেষত সেই সমাজে, যেখানে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে অন্যের কথা শুনিবার অভ্যাসটি ক্রমশ বিলুপ্ত হইবার পথে। এখানে সকলেই নিজ কথা বলিতে চাহে, অন্যের কথা না শুনিয়াই তাহাকে বিচার করিতে চাহে। যেন চিৎকার করিয়া নিজ মতটি কোনও ভাবে প্রতিষ্ঠা করিতে পারিলেই মোক্ষলাভ হইবে। অন্যে কী বলিতেছে, সেই কথা শুনিবার সময় এখানে কাহারও নাই। অথচ, যে কোনও বিতর্কের মূল কথাটিই হইল, পূর্বে অন্যদের মতগুলি সংক্ষেপে বলিয়া, তাহাকে যুক্তি-সহ খণ্ডন করিবার মাধ্যমে নিজ মতটি প্রতিষ্ঠিত করা। ‘পূর্বপক্ষ’-এর কথা শুনিবার রীতিটি এক কালে বিতর্কের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। কিন্তু কালক্রমে সেই অঙ্গ খর্বিত ও দুর্বল হইতে বিলীনপ্রায়। এখন বিপক্ষের মতটি এড়াইয়া গিয়া অথবা প্রবল আক্রমণে তাহাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করিয়া নিজের মত প্রতিষ্ঠা না করিতে পারিলে যথেষ্ট জেতা হয় না। এবং নিজ কথাটি প্রতিষ্ঠা করিবার ঝোঁকে অন্যের কথা প্রায়শই অশ্রুত থাকিয়া যায়, পরিণতির দিক দিয়া যাহাকে শুভ বলা চলে না। কারণ, শুনিবার অভ্যাসটি বন্ধ হইয়া গেলে উভয় পক্ষের মধ্যে এক দুর্লঙ্ঘ ব্যবধান জন্ম লয়। অন্যকে ভুল ভাবে বিচার করিবার প্রবণতা এবং নানা ভ্রান্ত ধারণার উৎপত্তি ইহারই এক প্রত্যক্ষ ফল। শোনার অভ্যাস শুধু তো অন্যকে জানিতেই সাহায্য করে না, তাঁহার অভিজ্ঞতা হইতে নিজেকে ঋদ্ধ করিতেও সাহায্য করে। এবং অচেনাকে চিনিবার মাধ্যমে নিজেকে নূতন ভাবে গড়িয়া তুলিবার সেই প্রক্রিয়ায়, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যাহাকে এত কাল মন অভ্রান্ত বলিয়া মানিয়া আসিয়াছে, যাহাতে স্থির বিশ্বাস রাখিয়া আসিয়াছে, তাহা আসলে ভ্রান্তিতে ভরপুর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy