দেশ জুড়ে নিজেদের ধরনে গাঁধীজির সার্ধশতবর্ষ পালন করছেন মোদী সরকার। মুখঢাকা গুন্ডারা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে বেপরোয়া লাঠি-রড চালাল ছাত্রছাত্রীদের উপর, পুলিশের উপস্থিতি আড়াল নয় সেখানে। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি চালাল রাষ্ট্রের পুলিশবাহিনী। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা গেল রাষ্ট্রের আগ্রাসী উপস্থিতি।
ছাত্রছাত্রীদের ওপর রাষ্ট্রপরিচালকদের আক্রোশ দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্র ও বাজার মিলে ‘উন্নত ভারত’-এর যে ছবি তৈরি করছিল তাতে দেশের যুবশক্তি ছিল অন্যতম প্রধান মৃগয়াক্ষেত্র। পাঁচ-ছ’বছর আগেও দেখা যাচ্ছিল ‘সফল’ জীবনের লক্ষ্যে চোখবাঁধা ঘোড়দৌড়ে শামিল উজ্জ্বল ছেলেমেয়েদের আর তাদের অভিভাবকদের উন্নয়নময় চেহারা। ‘দেশ’ ‘সমাজ’ ‘অন্য মানুষ’-এর মতো শব্দ যাদের জীবনে কোথাও আছে বলে মনে হয়নি। সেই যুবপ্রজন্মের মধ্যে এই সব বোধ জাগিয়ে তোলার মূল কৃতিত্ব হয়ত বর্তমান রাষ্ট্রচালকদের। পরিপার্শ্বে মিথ্যে প্রতিশ্রুতির বন্যা ছাড়া আর যা তাঁরা দিনের পর দিন চাপিয়ে দিয়েছেন, তা হল ভেদবুদ্ধি। ধর্মের নামে, জাতির নামে, ভাষার নামে।
দেশের মানুষদের জীবনধারণের প্রাথমিক অবলম্বন সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ‘উন্নয়ন’-এর নামে বিভিন্ন কর্পোরেটের হাতে তুলে দেবার মধ্যে দিয়ে দেশকে ক্রমশ নিঃস্ব করে তোলা হয়েছে। ক্রমশ বাড়ানো হয়েছে আমদানির পরিমাণ। মূল্যবৃদ্ধির হার মনে করাচ্ছে দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী জার্মানির কথা। জীবিকা ও জীবিকার মূল অবলম্বন প্রাকৃতিক-সম্পদের অধিকারচ্যুত কোটি কোটি মানুষ এখন বাজারের, সুতরাং শাসকেরও, বোঝা। তা থেকে ত্রাণ পাওয়ার এত কাল ধরে সবচেয়ে ‘সফল’ উপায় ছিল দাঙ্গা/যুদ্ধ বাধানো। এবারে সেটাকে এক অন্য মাত্রায় নেওয়া হচ্ছিল ‘নাগরিকত্বের অধিকার’-এর প্রশ্ন তুলে। দেশের অর্থনীতি হাঁটু ভেঙে পড়ছে, আর ‘অনাগরিক চিহ্নিতকরণ’-এর কাজে দেশ জুড়ে খরচ হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। শাসকদের দুর্নীতি একটা সাধারণ স্বীকৃত বিষয় হয়ে উঠেছে। দেশের সর্বোচ্চ অছিপরিষদ ক্রমাগত মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, মিথ্যা বিবৃতি, মিথ্যা হিসাব দিতে দিতে সকলের সামনে নিজেদের হাস্যাস্পদ করে তুলছে। ঠিক এই অবস্থাতেই শুরু হল ঘুরে দাঁড়ানো। যেখান থেকে প্রতিবাদের আশা করা হয়নি সেই তথাকথিত ‘স্বার্থপর, উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ ছাত্রসমাজ থেকে।
সত্যিই হয়তো নতুন এক প্রকৃত স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, ঘৃণা ও বিভেদপন্থার বিরুদ্ধে। অত্যাচার, মিথ্যাচার আর সন্ত্রাসপ্রচারের মুখোমুখি জেগে উঠেছে একটি ছবি— রক্তে ভেসে যাচ্ছে একটি প্রায়-কিশোরীর মুখ, আর সেই মুখে লেগে আছে অমলিন হাসি। ‘লাঠির জবাব সংবিধান’ বলছে সে। ভালবাসাই এই আন্দোলনের প্রধান বিশেষত্ব। নিজেদের টেনে নিয়ে আসা বিপদের মধ্যে আর ঠাট্টার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া ভয়-দেখানো রাক্ষসের দিকে। সদ্যোজাত শিশু কোলে দিনরাত সমাবেশে বসে থাকা মায়েদের ওপর বর্ষিত হল পীড়ন। খোলাখুলি তর্জন শুরু হয়েছে, ‘আমার কথা যদি না মানিস তবে...’! তবে কী করতে পারো তুমি? মারবে, এই তো? এফআইআর করা হয়েছে ঐশীসহ একুশ জনের নামে, যাদের মাথা ফেটেছে সন্ত্রাসবাহিনীর দাপটে। ত্রাসের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছে তরুণ প্রজন্ম। যারা দূরে ছিল এত দিন, ভাবতে হচ্ছে তাদেরও।
ভাবছি আর একটু পরের কথা। এই যে এক অপূর্ব উত্থান দেখা হল আমাদের, দেখার সৌভাগ্য হল দুনিয়া জুড়ে ইতিহাসের পাশমোড়া দেওয়া গত এক দশকে, আজ যার উজ্জ্বল সহযোগী আমার দেশও, সেইখানে আমি কী করতে পারি? ওদের পিঠের উপর পড়া লাঠি যে আমি নিজের শরীরে নিতে পারছি না, আমরা তবে কেমন করে হাত ধরব?
উজ্জ্বলতম আন্দোলনও তো চিরকাল চলে না, এক পর্যায়ে বিজয়লাভের পর স্তিমিত হয় আবার নতুন করে ফিরে আসার জন্য। সেই সময়ে ওই অগ্রসৈনিকদের কথা, এই নতুন চেতনার কথা, মূল্যবোধের কথা কাউকে না কাউকে তো বলে যেতে হবে। সেই কথা বলে যাওয়াই হয়তো আমাদের কাজ। বড় জনসভা নয়, নিজের আশপাশের মানুষদের সঙ্গে শ্রদ্ধা নিয়ে, সততা নিয়ে নিরন্তর বলে যাওয়া এই দেশকে, দেশের মানুষকে ভালবাসার কথা, যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়ানো আমার নিজের অস্তিত্ব। তার সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজন মনে হয় একটি প্রায়-ভুলে-যাওয়া শব্দকে জীবনে চর্চা করা— নৈতিকতা। সেখানে কেউ পাহারা দেবে না কিন্তু সেই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করাই কাউকে নিজের কথা শোনানোর একমাত্র পথ। অন্যের কথা শোনারও। আমার যে কাজ আমার চেয়ে দুর্বল কোনও মানুষকে কষ্ট দেবে, দুর্দশায় ফেলবে, সে কাজ অনৈতিক। ক্ষমতালাভের লোভ কী ভাবে যে কোনও আদর্শের পথ থেকে ভ্রষ্ট করে, সেই অভিজ্ঞতা প্রত্যেকের আছে, কী ঘরে, কী বাইরে। নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে হবে ন্যায়ের সপক্ষে আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য। যত বেশি জনের সঙ্গে স্বার্থহীন ভালবাসার কথা বলতে পারব, তত বেশি আমরা ওদের কাজে লাগব।
পুরনো রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলন-তরঙ্গের মধ্যে থেকেও নিজেদের পচা-দুর্গন্ধ ‘ফায়দা তোলা’-র চেষ্টা করবে। ছদ্মবেশী সঙ্কীর্ণতাবাদীরা আন্দোলন একটু স্তিমিত হলেই গর্ত থেকে মুখ বার করবে। বাইরের সম্মুখবাধার চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক এই সব ‘ছুরি মারা’ থেকে যেন এই আলোপথিকরা রক্ষা পায়, যেন এগিয়ে যেতে পারে। আমরা দেখবই। জান কবুল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy