Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

একটা ‘লাইক’-এ কত বিদ্যুৎ

ইন্টারনেট পরিষেবা চালানোর পিছনে বিদ্যুৎশক্তি ও জ্বালানির প্রয়োজন কতটা, এবং পরিবেশের উপর তার প্রভাব কী রকম হতে পারে, সেই খোঁজ আমরা সচরাচর নিই না।

সোমনাথ রায়
শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

ইন্টারনেট এখন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হরেক পরিষেবা অনেক সহজে পাচ্ছি, বিনোদনের নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছে। আবার, বিভিন্ন রকম কাজের সুযোগও বাড়ছে। সবই হচ্ছে নামমাত্র খরচে।

তবে, ইন্টারনেট পরিষেবা চালানোর পিছনে বিদ্যুৎশক্তি ও জ্বালানির প্রয়োজন কতটা, এবং পরিবেশের উপর তার প্রভাব কী রকম হতে পারে, সেই খোঁজ আমরা সচরাচর নিই না। তার একটা কারণ, ইন্টারনেটের সামগ্রিক পরিকাঠামোর মধ্যে একটা খুবই ছোট অংশ আমরা সামনে দেখতে পাই। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো, যেমন ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, বা ট্যাবলেট— এগুলি খুবই সামান্য বিদ্যুতে চলে। অন্য দিকে, এই পরিকাঠামোর মূল যন্ত্রগুলি আমাদের চোখের সামনে থাকে না। সেগুলি চালাতে যে বিপুল বিদ্যুৎ লাগে, আমাদের সে খোঁজ রাখার প্রয়োজন পড়ে না। ইন্টারনেট-ভিত্তিক ব্যবসার ধরনটা এমনই যে এই খরচ আমাদের কাছ থেকে সরাসরি তোলা হয় না।

ধরুন, আপনার বন্ধু রাজস্থান ঘুরতে গিয়েছেন। জয়সলমেঢ়-এ বালিয়াড়ির ওপর সূর্যাস্তের একটি চমৎকার ছবি ফেসবুকে দিলেন তিনি। আপনি লাইক করলেন, আপনাদের আর এক বন্ধু কমেন্ট করলেন, ‘অপূর্ব’। এই পুরো ব্যাপারটা কী ভাবে সম্ভব হচ্ছে? আপনার পর্যটক বন্ধুর তোলা ছবিটি তাঁর মোবাইল থেকে ইন্টারনেটের নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থায় ঢুকল, যার মধ্যে নেটওয়ার্ক সুইচ, অপটিকাল কেব্‌ল, মায় কৃত্রিম উপগ্রহ অবধি আছে। নেটওয়ার্ক-বাহিত হয়ে সেই ছবির প্রতিটি পিক্সেল, সেগুলির রঙের মাত্রা, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্য পৌঁছল ফেসবুকের নিজস্ব কম্পিউটার বা সার্ভারে। ওঁর প্রোফাইলের কোথায় ছবিটি আসবে, কারা দেখতে পাবেন, কারা প্রথমে দেখবেন সেই সব তথ্যও সেই কম্পিউটারের মেমরিতে রাখা হল। এ বার আপনারা যখন ছবিটি দেখতে চাইছেন, ফেসবুকের ওই নিজস্ব কম্পিউটার থেকে তথ্য ফের নেটওয়ার্ক-বাহিত হয়ে আপনাদের কাছে আসছে এবং আপনাদের লাইক বা মন্তব্যকে ফের সেই কম্পিউটারে নিয়ে যাচ্ছে। অনলাইন বিপণন, গেমিং বা নেট ব্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি আরও অনেক বেশি জটিল।

অর্থাৎ, আপনাদের নিজস্ব ফোন বা ল্যাপটপের বাইরে এই কর্মকাণ্ডের মূল দু’টি ধারক— নেটওয়ার্ক এবং ফেসবুকের মূল কম্পিউটার বা সার্ভার। এই মূল সার্ভারটি কী ভাবে কাজ করে? ফেসবুকের ‘ডেটাসেন্টার’-এ, অর্থাৎ যেখানে এই সার্ভার থাক, সেখানে হাজার হাজার কম্পিউটার থরে থরে সাজানো থাকে। কোন কাজ কোন কম্পিউটারে যাবে, তা স্থির করে একটা কার্যনিয়ামক প্রোগ্রাম। কম্পিউটার যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ জাতীয় সরল অঙ্ক কষতে পারে এবং হ্যাঁ-না জাতীয় সরল যুক্তি বুঝতে পারে। যে কোনও বড় কাজকে, যেমন ছবিতে ক’জন লাইক দিলেন, বা কার মন্তব্যে কে প্রতি-মন্তব্য করলেন, তাকে ওই সরল ধাপগুলিতে ভেঙে নেওয়া হয়। আর, এই প্রতিটি ধাপের কাজ সারতে প্রসেসরে বিদ্যুৎপ্রবাহের তারতম্য ঘটে।

অর্থাৎ, আপনার ফেসবুকে একটি লাইকের সঙ্গে ওই ডেটাসেন্টারে কতটা বিদ্যুৎ লাগছে, তার পরিমাণ জড়িয়ে থাকছে। তা ছাড়াও, এই বিদ্যুৎপ্রবাহের ফলে কম্পিউটারের ইলেক্ট্রনিক সার্কিটটি গরম হয়। কিন্তু কম্পিউটার সচল রাখতে হলে এই তাপমাত্রা বাড়তে দেওয়া চলে না। ফলে কম্পিউটার এবং ডেটাসেন্টার কক্ষটিকে ঠান্ডা করার জন্য বিশেষ ধরনের এয়ার কন্ডিশনিং প্রয়োজন হয়। গড়পড়তা হিসেব হল, কম্পিউটার চালাতে যতটা বিদ্যুৎ লাগে, তাকে ঠান্ডা করতে প্রায় ততটাই বিদুৎ লাগে। অর্থাৎ আপনার বন্ধুর ছবিতে ‘লাইক’ চিহ্ন বসাতে যত বিদ্যুৎ লাগার কথা, আসলে তার প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে।

২৫,০০০ পরিবারের বাস, এমন একটি শহরাঞ্চলে যত বিদ্যুৎ প্রয়োজন, একটি মাঝারি মানের ডেটাসেন্টার গড়পড়তা ততখানি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। ইন্টারনেটের ব্যবহার যত বাড়ছে, ডেটাসেন্টারের সংখ্যাও বাড়ছে। আর, আনুপাতিক হারে বাড়ছে বিদ্যুতের ব্যবহার। এখন বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে বিদ্যুতের দরকার বাড়ছে ইন্টারনেট পরিষেবার ক্ষেত্রেই। ডেটাসেন্টার, নেটওয়ার্ক এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রগুলি ২০৩০ সালে পৃথিবীর মোট বিদ্যুতের পাঁচ ভাগের এক ভাগ খরচ করবে বলে অনুমান। ইন্টারনেট পরিষেবার কার্বন ফুটপ্রিন্ট গত সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, বছরপ্রতি ৫-৬ শতাংশ হারে বাড়ছে।

সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধে এই সমস্যা নিয়ে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে ইন্টারনেট-জনিত উষ্ণায়ন এবং জ্বালানি-সমস্যার সমাধান হিসেবে বিকল্প ব্যবহারবিধি প্রস্তাব করা হয়েছে, যেমন ছোট ও মাঝারি ডেটাসেন্টার কমিয়ে এক্সাস্কেল ডেটাসেন্টার ব্যবহার করা, বিকল্প শক্তির ব্যবহার, ডেটাসেন্টারগুলিকে শীতল আবহাওয়ার জায়গায় নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল-এর মতো কিছু বড় সংস্থা সেই প্রস্তাব মেনে নিলেও বহু ছোট ও মাঝারি সংস্থা এখনও অরাজি।

ইন্টারনেট ব্যবহার করে ভারী ও সহায়ক শিল্পে অনেক ধরনের অপচয় কমানো গিয়েছে। উৎপাদনের কর্মকুশলতা বাড়িয়ে এই সব ক্ষেত্রে শক্তির প্রয়োজন কমানো গিয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। ২০১৪ অবধি দেখা যাচ্ছিল, ইন্টারনেটের নিজস্ব বিদ্যুৎচাহিদাবৃদ্ধি কিন্তু এক ভাবে পূরণ হয়ে যাচ্ছিল বাকি ক্ষেত্রগুলিতে ইন্টারনেট ব্যবহারজনিত লাভের মাধ্যমে। কিন্তু, ২০১৪-র পর থেকে ইন্টারনেটের বিদ্যুৎ চাহিদা বাকি ক্ষেত্রগুলির চাহিদা হ্রাসকে ছাপিয়েছে। এখন থেকেই বিনোদনের জন্য ইন্টারনেটের ব্যবহার ভীষণ ভাবে বাড়ছে। সাম্প্রতিক হিসাবেও ইন্টারনেটে তথ্যের ট্র্যাফিক সবচেয়ে বেশি বিনোদনের জন্যে, যার মধ্যে বিনোদনমূলক ওয়েবসাইটগুলির পাশাপাশি ব্যক্তিগত স্তরে উচ্চ মানের ফটো ও ভিডিয়ো শেয়ারিংও আছে। পরিবেশের উপর ইন্টারনেটের ভার কমাতে ব্যবহারের এই দিকটির উপর কিছু বিধিনিষেধ, এবং সর্বোপরি ব্যক্তিগত স্তরে সচেতনতা খুবই প্রয়োজন।

অন্য বিষয়গুলি:

Social Media Electricity Internet
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy