Advertisement
২৮ নভেম্বর ২০২৪

‘বঙ্গ’ নামটির ঐতিহাসিক ও ধারাবাহিক তাৎপর্য রয়েছে

অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত কোনও হিন্দু কবি তাঁদের লেখায় ‘বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার পর্যন্ত করেননি। গৌড়বঙ্গ হিসেবেই তাঁরা ভৌগোলিক চিহ্নিতকরণ করতেন। লিখছেন দেবাশিস ভৌমিকবাংলা, যেহেতু ফারসি শব্দ, তাই তা নিয়ে রক্ষণশীল বাঙালির আপত্তি যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত কোনও হিন্দু কবি তাঁদের লেখায় ‘বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার পর্যন্ত করেননি।

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৯ ০০:৫৬
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ রসিকতা করে একদা বলেছিলেন, নাম অনেকটা লাউয়ের বোঁটার মতো। থাকলে ধরতে সুবিধে হয়। পশ্চিমবঙ্গের নাম আগামী দিনে কী হওয়া বাঞ্ছনীয়, তা নিয়ে সে কারণেই কি প্রায় প্রতিটি দশকে এক বার করে নামায়ন বিতর্ক জেগে ওঠে?

আবার, কালের নিয়মে তা ঝিমিয়েও যায়। গত বছর এই রাজ্যের নাম বাংলা করতে চেয়ে বর্তমান রাজ্য সরকার দিল্লির কাছে দরবার করল। সম্প্রতি কেন্দ্রের তরফ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সংবিধান সংশোধন ছাড়া রাজ্যের নাম পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। বিতর্কটা যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেল। বর্ণমালাগত অবস্থানের কারণে সংসদ-বক্তৃতায় বক্তা ও শ্রোতার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে পশ্চিমবাংলা নামে। এটাই রাজ্য সরকারের তরফে আপত্তির মূল কারণ। তারা তাই রাজ্যের নাম বাংলা চান। পণ্ডিতমহলে রায় চাওয়া হলে তাঁরা বলেন, কথাটার যুক্তি রয়েছে। যার পূর্ব নেই, তার পশ্চিম থাকে কী করে? অতএব, পশ্চিম ছেঁটে ফেলে বঙ্গ বা বাংলার পক্ষেই তাঁরা মত দিলেন। কেউ কেউ আবার তাতে দুঃখ পেয়ে বললেন, ‘পশ্চিম’ শব্দের মধ্যে ঢুকে রয়েছে দেশভাগের তীব্র যন্ত্রণার ইতিহাস। তাকে এক কলমের খোঁচায় উড়িয়ে দিলে বড়ই অবিচার করা হবে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের স্মৃতির উপর। তাই থাক না পশ্চিম শব্দটা। ক্ষতি তো কিছু করছে না।

বেশি পুরনো এবং কম পুরনো, এই ভাবে ইতিহাসের দুটো অংশ করে নিলে বিতর্কিত ভূখণ্ডের নামকরণে দু’রকম তথ্য উঠে আসে। একটি হল ‘বঙ্গ’ নামের পক্ষে অন্যটি ‘বাংলা’। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘History of Ancient Bengal’ গ্রন্থে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে, ১১৩০ খ্রিস্টাব্দে লেখা ‘মানসোল্লাস’ নামে একটি সংস্কৃত গ্রন্থে ‘বঙ্গ’ নামের উল্লেখ দেখা যাচ্ছে। এই সময়ের নানা সংস্কৃত কবিতাতেও কবিরা বারবার ‘বঙ্গ’ শব্দটিকে স্থান নাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সর্বানন্দের লেখা ‘অমরকোষ’-এর টিকায় ব্যবহৃত একাধিক শব্দগুচ্ছে ‘বঙ্গ’ কথাটির উল্লেখ রয়েছে। আরও পুরনো আমলে পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, পঞ্চম শতাব্দীতে প্রাপ্ত শিলালিপিগুলিতে শুধু স্থাননাম নয়, ব্যক্তিনাম হিসেবেও ‘বঙ্গ’ কথাটির উল্লেখ রয়েছে। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ লেখা ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’-এর বেশ কিছু পংক্তিতে ‘বঙ্গ’ শব্দকে জায়গার নাম হিসেবে দেখানো হয়েছে। ‘বঙ্গ’ নামের এই ভৌগোলিক ঐতিহ্যকেই মধ্যযুগের বাঙালি কবিরা বারবার তাঁদের লেখায় ব্যবহার করেছেন।

অন্য দিকে বাংলার পক্ষে যাঁরা, তাঁরা জানেন যে, মুঘল যুগ আসার আগে পর্যন্ত ‘বঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গাল’ শব্দের অস্তিত্বই ছিল না। এই যুগের ‘সুবা বাঙ্গালা’ আর ইংরেজদের কথিত ‘বাংলা’ বা Bengal-এর ভৌগোলিক অবস্থান একই। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, ১২০২ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি আক্রমণের ফলে লক্ষণ সেন যে অঞ্চলে এসে রাজত্ব করেছিলেন ‘তবাকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে তার নাম বলা হচ্ছে ‘বঙ্গ্’ বা ‘বঙ্গ’। ‘দ্য জার্নাল অব দ্য ন্যুমিসম্যাটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে প্রদত্ত তথ্য ‘বঙ্গ’ নামের পক্ষেই জোরাল প্রমাণ দেয়। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গ-বাঙ্গালা ও ভারত’ গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে, মা হুয়ান নামে একজন চিনা লেখক তাঁর ‘ইয়িং-য়াই-শেন-লান’ গ্রন্থে বঙ্গদেশে আসার কথা বলছেন। এই বঙ্গাল যে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও আজকের বাংলাদেশের অনেকটা জুড়ে বিস্তৃত ছিল, তা অনুমান করে নিয়েছেন ঐতিহাসিকেরা। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি (১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে) ‘পঞ্চগৌড়’ নামে একক দেশ হিসেবে মুসলিম শাসকেরা ‘বাঙলা’ নামটির প্রচলন ঘটান। ভাষাতাত্ত্বিক ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত ছিল, ফার্সি ভাষাভাষী মুসলিমেরা এই অঞ্চলের ভাষাকে ‘বঙ্গালহ্’ নামে অভিহিত করেছিলেন।

বাংলা, যেহেতু ফারসি শব্দ, তাই তা নিয়ে রক্ষণশীল বাঙালির আপত্তি যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত কোনও হিন্দু কবি তাঁদের লেখায় ‘বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার পর্যন্ত করেননি। গৌড়বঙ্গ হিসেবেই তাঁরা ভৌগোলিক চিহ্নিতকরণ করতেন নিজেদের কাব্যে। বঙ্গ সাহিত্যের আদি কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর ‘রামায়ণ পাঁচালী’তে ‘বঙ্গ’ শব্দটিকেই ব্যবহার করেছেন, ‘বঙ্গদেশ প্রমাদ হৈল সকলে অস্থির।/ বঙ্গদেশ ছাড়ি ওঝা আইল গঙ্গাতীর।।’ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ও ‘বাংলা’ শব্দের উল্লেখ নেই। মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’এ তো নেই। বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্য মঙ্গল’ এবং ‘চৈতন্যভাগবতে’ এই নির্দিষ্ট ভূখণ্ডটিকে ‘গৌড়’ নামেই চিহ্নিত করা হয়েছে, ‘‘গৌড়ের নিকটে গঙ্গাতীরে এক গ্রাম।/ ব্রাহ্মণসমাজ তার রামকৌল নাম।।’’

এই ধারাটা চলে এসেছিল রাজা রামমোহন রায়ের সময় পর্যন্ত। ১৯ শতকে তিনি যে ব্যাকরণ গ্রন্থটি লেখেন, তার নাম দেন ‘গৌড়ীয় ভাষার ব্যাকরণ’। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘গৌড়’ নামটির প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বল ছিলেন বলেই বোধ হয় তাঁকে লিখতে হয়েছিল, ‘‘তুমিও আইস, দেবী, তুমি মধুকরী/ কল্পনা! কবির চিত্তফুল-বনমধু/ লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে/ আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।’’ তাঁর ‘বঙ্গ’ নামের প্রতি আসক্তির নিদর্শন খোদাই করা আছে সমাধি-লিপিতেও— ‘‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল।’’ আরও পরে লেখা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই কিংবদন্তি পংক্তিটিও এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে— ‘‘বঙ্গ আমার, জননী আমার, ধাত্রী আমার, আমার দেশ।’’ ফলে, স্থাননাম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এই ভূখণ্ড ‘গৌড়’ যতটা, ততটাই ‘বঙ্গ’।

সংস্কৃত ‘বঙ্গ’ শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত আলি প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘বঙ্গালী’ শব্দটির জন্ম। আলি প্রত্যয়ের মানে হল, জমির সীমানা। মুঘল শাসনে আলি শব্দটির উচ্চারণ দাঁড়ায় ‘আল্’। তা থেকেই ‘বঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গালা’ শব্দের আবির্ভাব। ১৮০০ শতাব্দীর তাঞ্জোর শিলালিপিতে ‘বঙ্গলম্’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। কেউ কেউ আবার বলেছেন, ‘বঙ্গ’ নামটির উৎপত্তি সাঁওতাল দেবতা ‘বঙ্গা’থেকে। স্থাননাম হিসেবে ‘বঙ্গ’ শব্দের প্রাচীনতাকে অস্বীকার করেননি কেউই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ নামটির তাৎপর্য বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে ভেবেছিলেন, আজ আর তার তেমন গুরুত্ব আছে বলে মনে করেন না অনেকেই। পূর্ববঙ্গ সাতের দশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আলাদা হয়ে যাবার পর পশ্চিম শব্দটি অহেতুক, কোনও মানে রাখে না। দেশভাগের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করার জন্য তাকে এ রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়ে ঘোরানো অবান্তর। সে ক্ষেত্রে ‘বঙ্গ’ নামটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। তার কারণ, ‘বঙ্গ’ নামটি ছোট। সহজ উচ্চার্য। লেখার শ্রম লাঘব হয়। আধুনিক বৈদ্যুতিন যন্ত্রে ছোট নাম নথিভুক্ত করা সহজ। বিদেশি বা অবঙ্গবাসীর মুখে এ নাম বিকৃত উচ্চারণের সম্ভাবনা কম। কেননা, তারা ‘কঙ্গো’ নামটি সহজেই উচ্চারণ করতে পারেন। ‘বঙ্গ’ নামের ক্ষেত্রেও তাই কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আরেকটি কথা, ‘বঙ্গ’ নামটির ঐতিহাসিক ও ধারাবাহিক যে তাৎপর্য রয়েছে, তাকেও সসম্মানে রক্ষা করা যায়। রাজ্যের নাম ‘বঙ্গ’ হলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রম অনুসারে তা অনেক উপরের দিকে উঠে আসবে। খরচের কথা ভাবলে দেখা যাবে, ‘বঙ্গ’ নামটি সংক্ষিপ্ত হওয়ায় অনেক কম খরচে গোটা রাজ্যে নাম পরিবর্তন করা সহজ হবে।

সব চেয়ে বড় কথা হল, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে ‘বঙ্গ’ শব্দটি প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে আবেগের মাতৃভূমি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, তা যথাযথ ভাবে চিহ্নিত ও সম্মানিত হবে। বঙ্গীয় সংস্করণ, বঙ্গাব্দ বঙ্গবাসী ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে এ রাজ্যের মানুষ আজ এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন যে ‘বাংলা’ শব্দের বিশেষণ নতুন করে বানিয়ে নেওয়া, তার পক্ষে আজ আর কোনও মতেই সম্ভব নয়। বাংলার সত্যিই যে বিশেষণ হয় না।

কালিয়াগঞ্জ কলেজের শিক্ষক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy