শোলাপুকুর মসজিদ। ছবি: উদিত সিংহ
নানা স্থাপত্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গোটা পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়ে। প্রাচীন জনপদ হওয়ার কারণে উভয় সম্প্রদায়ের নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য এখানে গড়ে উঠেছে। হিন্দু দেবদেবীর মন্দির ও দেউলের নানা কারুকার্যে যেমন নান্দনিক শোভার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনই, জেলার বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রাচীন মসজিদগুলির গঠনশৈলীও জেলার স্থাপত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
মোঘল আমলে বর্ধমানকে বলা হত ‘সরিফাবাদ’, অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বসবাসের স্থান। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে ষোড়শ শতকের শেষের দিকে মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে সমগ্র বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করা হয়েছিল, তার মধ্যে সরিফাবাদের অন্তর্ভুক্ত বর্ধমানের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। দিল্লির সম্রাটদের জীবনের বিশেষ বিশেষ সময়ে নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছিল বর্ধমান। শাহজাহান থেকে শেরশাহ, নূরজাহান থেকে আজিম-উস-সান, ফারুকশিয়র— দিল্লি থেকে বহু দূরে এই ‘সরিফাবাদ’-এ এসেছিলেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বর্ধমান জেলার নানা জায়গায় সে সব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উপাসনাস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একাধিক মসজিদ, মক্তব। আবার গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহ বা দিল্লির সম্রাটেরা বর্ধমানের নানা পীর, ওলি এবং আওলিয়াদের মাজারের কাছে মসজিদ নির্মাণ ও পুকুর খননও করেছিলেন।
অখণ্ড বর্ধমানের প্রাচীন মসজিদগুলি জেলার ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন। শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যে মসজিদগুলিতে পারসিক শিল্পরীতির প্রভাব যেমন রয়েছে তেমনই লক্ষণীয় ইসলামিক শিল্পরীতির সঙ্গে গৌড়ীয় শিল্পরীতির মিলন। এ ছাড়াও, বেশ কিছু প্রাচীন মসজিদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক চরিত্রেরা। কথিত রয়েছে, বর্ধমান শহরের পুরাতনচকে খোক্কর সাহেবের মাজারের কাছে কালো মসজিদটি শেরশাহ ৯৫০ হিজরিতে (১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দ) তৈরি করেছিলেন। মসজিদে আজও রয়েছে শেরশাহের লিপি। হুমায়ুন চুনার দুর্গ আক্রমণ করে সময় নষ্ট করতে থাকেন, সেই সুযোগে শেরশাহ বর্ধমানে পালিয়ে এসে পরের পদক্ষেপের প্রস্তুতি নেন। পরে দিল্লির সিংহাসনে বসে এই মসজিদটি নির্মাণ করে দেন।
সাহাচেতনপুরে পীর বাহারামের মাজারের সঙ্গে রয়েছে আরও একটি প্রাচীন মসজিদ। পীর বাহারাম ছিলেন সম্রাট আকবরের শ্রদ্ধাভাজন, কিন্তু আবুল ফজলের তা পছন্দ না হওয়ায় পীর বিরক্ত হয়ে বর্ধমানে এসে যোগী জয়পালের আশ্রমে আশ্রয় নেন। ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে ওই সাধকের জীবনাবসান হলে আকবর পীর বাহারামের মাজার নির্মাণ করে দেন এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চারটি মৌজা দান করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের নাতি আজিম-উস-সান শোভা সিংহের হাতে মহারাজ কৃষ্ণরাম রায়ের হত্যার পরে বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করার জন্য বর্ধমানে এসেছিলেন। সেই ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে, তিনি আলমগঞ্জে তিন গম্বুজওয়ালা মসজিদটি নির্মাণ করান।
বর্ধমানের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে নবাববাড়ি বা খাজা আনোয়ার বেড়ের সমাধিক্ষেত্রে রয়েছে এক প্রাচীন মসজিদ। কৃষ্ণরাম রায়ের কন্যা সত্যবতীর হাতে শোভা সিংহের মৃত্যুর পরে বিদ্রোহী দলের লাগাম চলে যায় পাঠান রহিম খাঁর হাতে। এই রহিম খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় আজিম-উস-সানের উজির খাজা আনোয়ারের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। তাঁর স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখতে সম্রাট ফারুখশিয়র এই মসজিদ ও সমাধি তৈরি করান। আবার ফারুখশিয়র তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু সুফি বায়াজিদের সম্মানে বর্ধমান-কালনা রোডে প্রতিষ্ঠা করেন বন মসজিদ।
বর্ধমানে থাকার সময় আজিম-উস-শানের সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই পুত্র করিমউদ্দিন ও ফারুখশিয়র। এক দিন তিনি দুই পুত্রকে পাঠালেন জিন্দাপীর হজরত বায়াজিদের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনার জন্য। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, পীরের সাধনকক্ষে আজিম-উস-শানের দুই পুত্রের মধ্যে ফারুখশিয়র হজরত বায়াজিদের আশ্রয় পান। পরে সম্রাট হয়েও ফারুখশিয়র সুফি বায়াজিদকে ভোলেননি। তিনি তাঁর স্মৃতিতে বর্তমানে বর্ধমান-কালনা রোডের ধারে অবস্থিত বন মসজিদটি তৈরি করে দেন।
বর্ধমানের মূল শহরে অবস্থিত প্রাচীন মসজিদগুলির মধ্যে অন্যতম ইছলাবাদের তিন গম্বুজওয়ালা মসজিদ, বিসি রোডে পায়রাখানা গলিতে অবস্থিত প্রাচীন নূর মসজিদ, কাটরাপোতার প্রাচীন তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, তেঁতুলতলা বাজারে মদিনা মসজিদ, রাধানগরপাড়ার মক্কা মসজিদ, গোদা অঞ্চলের সান মসজিদ, পুরনোচকে কালো খাঁ মসজিদ প্রভৃতি।
অজয় নদের তীরে মঙ্গলকোটের বারো দরজা মসজিদটিও বিখ্যাত। কথিত রয়েছে, সিংহাসনে বসার আগে শাহজাহান মঙ্গলকোটে এসে আত্মগোপন করেছিলেন। এখানে সুফি সাধক মওলানা হামিদ দানেশমন্দ-এর সান্নিধ্যে আসেন তিনি। ১৬৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান ৯৪ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ব্যয়ে মসজিদটি তৈরি করেন। দাঁইহাটে একটি মসজিদ হোসেন শাহ তৈরি করেছিলেন বলে কথিত। এ ছাড়াও ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে শাহ আলম খান প্রতিষ্ঠিত ছ’গম্বুজ ওয়ালা প্রাচীন মসজিদ, বাদশাহি সড়কের ধারে রায়খা ও কুলটি গ্রামের প্রাচীন দু’টি মসজিদ হোসেন শাহের আমলে তৈরি বলা হয়।
কালনা অঞ্চলে দাঁতনকাঠিতলায় রয়েছে টেরাকোটা ভাস্কর্যের মসজিদ-ই-জামিয়া। এটি ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের সময়ে উলুঘ মুসুয়ানি খাঁ তৈরি করেন। এ ছাড়াও ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি আবুল মুজাফফর বাহাদুর শাহের নির্মিত মসজিদ, বদর সাহেবের মসজিদ, ১৪৯০ খ্রিষ্টাব্দে মামুদ শাহের রাজত্বকালে মজলিস সাহেবের মসজিদ, শাসপুর-দিঘির পাড়ের হাবসি রাজাদের প্রাচীন মসজিদ, পূর্বস্থলীর জাহাননগরের জাহান আলি খানের সময়ে প্রাচীন মসজিদ ইত্যাদি এই জেলার প্রাচীন মসজিদগুলির মধ্যে অন্যতম।
কাটোয়ার বাগান পাড়ায় চার মিনার ও ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট প্রাচীন মসজিদটি শাহ আলমের সময়ে তৈরি। ভাতার থানার কালুত্তক গ্রামে হজরত কালুত্তক সাহেবের মাজারের কাছে প্রাচীন মসজিদটি হোসেন শাহ তৈরি করেন।
কেতুগ্রামের নরসিংহপুর ও কুলুট গ্রামে প্রাচীন মসজিদ, বেলওয়ারি গ্রামের মসজিদের অলঙ্করণ খুবই সুন্দর। মালডাঙার বোহার গ্রামেও প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। কুলুইতি গ্রামের মাটির খিলানের প্রাচীন মসজিদটি উনিশ শতকে নির্মিত। ভাতারের এরুয়া গ্রামে পাঁচটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। পূর্বস্থলীর মেড়তলা গ্রামে তালপাতা পাড়াতেও একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। আউশগ্রামের সর গ্রামের পাঠান পাড়ায় এক গম্বুজওয়ালা প্রাচীন মসজিদ, দিগনগর গ্রামে ভগ্নপ্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো মসজিদ, বুদবুদের মারোকোটা গ্রামে প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এর কাছেই গলসি অঞ্চলের আদড়াহাটি, জাগুলপাড়া, মসিদপুর, সরমারো-কোটাগ্রামের প্রাচীন মসজিদ ও ভূড়ি গ্রামের প্রাচীন মসজিদের ভগ্নাবশেষ জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসে বিশিষ্টতার দাবি রাখে।
জেলার ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন মসজিদগুলির বেশিরভাগই বর্তমানে সংস্কারের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে। শুধু মসজিদই নয়, জেলার বহু প্রাচীন মন্দির, দেউল অবহেলা আর উদাসীনতায় প্রচারের অন্তরালে থেকে গিয়েছে। অথচ এগুলির ঠিকঠাক সংরক্ষণ ছাড়া বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার পূর্ণতা পাওয়া অসম্ভব।
টেরাপুর পল্লিমঙ্গল হাই মাদ্রাসার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy