এমনই অবস্থা শিলাবতীর। নিজস্ব চিত্র।
পুরনো কথাটা হল, আমাদের নদীমাতৃক সভ্যতা। আর কথাটা ছোটবেলা থেকেই আমরা জানি। কারণ বইয়ে পড়া। এতে নদীর গুরুত্বটা পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে। যে নদীর সঙ্গে লোককথা জুড়ে যায় সে নদীও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জনজীবনে গুরুত্ব রয়েছে বলেই তাকে নিয়ে ভেবেছে মানুষ। তৈরি হয়েছে জনশ্রুতি। কিন্তু সেই নদীই যদি ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে যায়, তাহলে? মন খারাপ হয়। কিন্তু আসন্ন বিপদটা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না।
শিলবতী তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ নদী। গোটা দেশ জুড়ে নদীর দূষণ নিয়ে এখন চর্চা চলছে। কারণ মিষ্টি জলের ভাণ্ডার কমছে ক্রমশ। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলাবতীকে নিয়ে এখনও তেমন কোনও সংগঠন কিংবা পরিবেশকর্মীরা কাজ শুরু করেনি। নজর নেই প্রশাসনেরও।
শিলাবতীতে মাঝে মধ্যেই ভেসে আসে থার্মোকলের থালা-বাটি। উৎসব-অনুষ্ঠানের মরসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে প্লাস্টিক-থার্মোকলের থালা নদীর উপরে বাঁশের সাঁকোতে আটকে পড়ে। স্থানীয়রা সাঁকো বাঁচাতে বাঁশে করে ঠেলে দেন ওই আবর্জনা। ফের সেগুলো ভাসতে থাকে নদীর জলে। শিলাবতী নদীতে এক চেনা দৃশ্য। বহুদিন থেকেই শিলাবতী নানা ভাবে অত্যাচারিত। এই অঞ্চলে কোনও কলকারাখানা নেই। স্বাভাবিক ভাবে কারখানার বর্জ্য নদীকে দূষিত করেনি। তবে জনবসতি সেই ঘাটতি পূরণ করে দিয়েছে। কেমন ভাবে ছড়াচ্ছে দূষণ? যে কোনও সময়ে গেলেই দেখা যাবে, নদীর পাড়ে জঞ্জালের স্তূপ। বালি-সহ নদীর নানা সম্পদ সংগ্রহের সময় অবৈজ্ঞানিক ভাবে কাটা হচ্ছে নদীর তলদেশ। তাতে চাপ পড়ছে পাড়ের দিকে। নদীর পার বরাবর ঘুরে দেখলে এমন নানা অত্যাচারের চিহ্ন দেখা যাবে শিলাবতীর অববাহিকায়। দূষণের কথা মানছেন ঘাটাল পুরসভার আধিকারিক থেকে জনপ্রতিনিধিরা। সেচ দফতরও। তবে দূষণ ঠেকাতে কোনও পদক্ষেপ এখনও করা হয়নি। মানুষের সৃষ্টি দূষণের কবল থেকে মুক্তি কবে মিলবে নদীর? উত্তর জানা নেই কারও।
পুরুলিয়া থেকে উৎপত্তি শিলাবতীর। নদীর উৎপত্তি নিয়ে একটি গল্পগাথা প্রচলিত। আর তাতেই বোঝা যায় এর গুরুত্ব। এক ব্রাহ্মণের কাছে আশ্রয় পেয়েছিলেন শিলাবতী নামে এক মহিলা। জনশ্রুতি, তাঁর নামেই এই শিলাবতী। এই নদীকে কেন্দ্র করে একসময় ঘাটালে গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যকেন্দ্র। ঘাটাল নামকরণেও শিলাবতী ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। একসময়ে ঘাটাল শহরে স্টিমার চলত। ঘাটালের প্রবীণেরা ছোটদের এখনও সেই গল্প শোনান। সেই শিলাবতী এখন দূষণের কবলে। ক্রমশ হারাচ্ছে তেজ।
নদীটির দূষণ সমস্যা আজকের নয়। তবে দূষণ চোখে পড়েছে তিন-চার দশক আগে থেকে। বহুদিন আগেই নাব্যতা কমেছে নদীটির। ফলে জলপথ পরিবহণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পলি তুলে সংস্কার করা হয়নি। নদীর জলধারণ ক্ষমতা কমায় ঘাটালে বন্যা প্রতি বছর একটি বড় সমস্যা। এ ছাড়াও বিভিন্ন নদী, খাল-বিল, পুকুরের রাশি রাশি জল এসে মিলিত হয় শিলাবতীতে। এই জলরাশিও বয়ে আনে নানা আবর্জনা। তাতেও শিলাবতী ভরাট হচ্ছে। এতে কিন্তু নদীর বাস্তুতন্ত্রেও দারুণ প্রভাব পড়ছে। একসময়ে শিলাবতী নদীতে পাওয়া যেতে ইলিশ, চিংড়ি। মাছ ধরে বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু নদীর নাব্যতা কমায়, দূষণ বাড়ায় মাছ কমেছে বহু। স্বাভাবিক ভাবেই কমেছে মৎস্যজীবীর সংখ্যা। নদী বিশেষজ্ঞরা জানালেন, এখনই হাল ধরতে হবে। তা না হলে একসময় নদীর বাস্তুতন্ত্র পুরোপুরি নষ্ট হবে। তখন নদী তীরবর্তী নগর-গ্রামেও তার প্রভাব পড়বে। নাব্যতা সঙ্কটে নানা বর্জ্য পদার্থ নদীর তলদেশে জমছে। তাতে জীব বৈচিত্রের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে।
শিলাবতী দূষণের অন্যতম কারণ হল, নদীর পাড়ে ডাঁই করে রাখা জঞ্জাল। গ্রামাঞ্চলে প্রবাহিত অংশের তুলনায় ঘাটাল শহরের চেহারাটা আরও ভয়ানক। ঘাটাল শহরের নদী পাড়ের একাংশে আবর্জনায় ভর্তি। অনেকে জেনে বুঝে, আবার অনেকে সাতপাঁচ না ভেবে নদীর পাড়কেই জঞ্জাল ফেলার স্থায়ী ঠিকানা করে নিয়েছেন। দিনের পর দিন বছরের পর বছর ধরে এই ভাবেই নদীর পাড়ে জমছে জঞ্জালের স্তুপ। এই আবর্জনা সরাসরি নদীর জলে মিশছে। ফাঁকা হচ্ছে নদীর পাড়। কিছুদিন পর আবার নদীর পাড় আবর্জনায় ঢেকে যায়। ফের গিয়ে পড়ে নদীর জলে। নদীর পারে রাজনগরে বসবাসকারীদের আক্ষেপ, এখন শিলাবতীর যা হাল তাতে মনে হয়, এ কোনও নদী নয়। যেন একটা ডাস্টবিন।
স্থানীয় বাসিন্দা এবং পরিবেশ সংগঠনগুলির অভিযোগ, ঘাটাল শহরে নদীর দুই পাড়ের একাংশে আবর্জনা ফেলা এখন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হোটেল-রেস্তরাঁর আবর্জনা নদীতে এসে মিশছে। প্লাস্টিক-থার্মোকলও জমা করা হয় নদীর পাড়ে। নদী তীরবর্তী গ্রাম বা শহরের অনুষ্ঠানের পর উচ্ছিষ্ট, পাতা, সবই ফেলা হয় নদীর জলে। নয়তো নদীর পাড়ে। কখনওসখনও পুরসভা এবং পঞ্চায়েত এলাকার আবর্জনাও ফেলা হচ্ছে নদীর পাড়ে। অন্যদিকে শিলাবতীতে দখলও বাড়ছে। ঘাটাল শহরের নদীর দুই পাড়ের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। নদীর গা ঘেঁষে বড় বড় পিলার উঠছে। তৈরি হচ্ছে দোকান, বাড়ি। নদীর পাড়ে বাঁশের কাঠামোয় অসংখ্য দোকান ঘর তৈরিতে নদীর স্বাভাবিক গতি বাধা পাচ্ছে। সেচ দফতর মানছেন, শিলাবতী নদীর দুই পাড়ে প্রায় সত্তর ভাগ জমি অন্যের দখলে। সেখানে কেউ স্থায়ী ভাবে বাড়ি করে বসবাস করছেন। কেউ আবার ব্যবসা করছেন। শিলাবতী নদী থেকে ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোনার একাংশে বালি তোলা হয়। পরিবেশকর্মীরা জানালেন, বালি সংগ্রহের জন্য যন্ত্র নামিয়ে নদীর তলদেশ এমন ভাবে কাটা হচ্ছে তাতে নদীর বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব পড়ছে।
পরিবেশকর্মী এবং ঘাটাল শহরের বাসিন্দাদের মতে, নদীর পাড় জঞ্জাল ফেলা বন্ধ করতে উদ্যোগ করতে হবে প্রশাসনকে। সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। নদী যাতে নির্মল থাকে তার জন্য সচেষ্ট হতে হবে আরও। নদীর সম্পদ ব্যবহারের সঙ্গে অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। স্বাভাবিক গতি আটকে নদীখাত দখলে রাশ টানতে হবে প্রশাসনকে। চন্দ্রকোনার এক পরিবেশ সংগঠনের তরফে ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “সবার প্রথমে আমাদের সচেতন হতে হবে। নদীর উপর অত্যাচার বন্ধ আমরাই করতে পারি। যদি একযোগে কাজ করি।”
পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে ঘাটালের বাসিন্দারা চাইছেন, শিলাবতীর শ্রী আগের অবস্থায় ফিরে আসুক। পুরসভাও উদ্যোগী হোক। অন্তত নদীর পাড়ে নোংরা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে এগিয়ে আসুন বাসিন্দারা সকলে।
না হলে নদীর জীবন নষ্ট। আর সেই নষ্টের প্রভাব কিন্তু এসে পড়বে মানুষের উপরেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy