ফাইল চিত্র
যোগী আদিত্যনাথ ইতিহাস রচনা করিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে বসিয়া পুলিশি বাড়াবাড়িকে নূতন ঘটনা বলা যাইবে না। কিন্তু তাহার মধ্যেও পুলিশ-প্রশাসনের স্পর্ধা ও নীচতা কোন অতলে নামিতে পারে, তাহা দেখাইয়া দিল যোগীশাসিত উত্তরপ্রদেশ। হাথরস-কাণ্ডের পর নির্যাতিতা ও তাঁহার পরিবারের প্রতি পুলিশের বড় কর্তা হইতে ছোট পেয়াদা পর্যন্ত প্রতি স্তরের অকল্পনীয় হিংসা ও রূঢ়তা প্রকাশিত হইয়াছে, রাজনৈতিক বিরোধী হইতে সাংবাদিক সকলের বিরুদ্ধে তাহারা খড়্গহস্ত হইয়াছে। একে দরিদ্র পরিবার, তাহার উপর দলিত, তাহার উপর নারী— হাথরসের ঘটনায় পুলিশ কোন দিকে থাকিবে, তাহা বুঝিতে কাহারও অসুবিধা ছিল না। কেবল সেই আশঙ্কার মাত্রা বহু গুণ ছাপাইয়া গিয়াছে যোগীর পুলিশবাহিনীর কাণ্ডকারখানা, ইহাই সংবাদ। ভারতীয় উপমহাদেশে পুলিশ সর্বদাই রাষ্ট্রের ভারী পছন্দের নিষ্পেষণ-যন্ত্র। তবু সেই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতেও যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ বিরাট ‘কৃতিত্ব’ দাবি করে।
হাথরস হিমশৈলের চূড়ামাত্র। গত তিন বৎসরের শাসনকালে যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ দ্বিধাহীন শঙ্কাহীন ভাবে যথেচ্ছাচারে মগ্ন থাকিয়াছে— অন্যান্য বহু হিসাব তাহা বুঝাইয়া দেয়। হিন্দু-মুসলিম নরনারীর সম্পর্ককে ‘লাভ জিহাদ’ বলিয়া দাগাইয়া যে পরিমাণ অত্যাচার ঘটিয়াছে, সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের যে প্রকার নির্যাতন হইয়াছে, এবং সর্বোপরি, রেকর্ড সংখ্যক এনকাউন্টার হত্যা ঘটাইয়া রাজ্যের পুলিশ ইতিপূর্বেই দেশেবিদেশে আলোচ্য বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার পর ‘যোগীর পুলিশ’ বর্তমান ভারতে ভয়ঙ্করতম শব্দবন্ধ বলিয়া গণ্য হইতে পারে। এই বিষয়ে দুইটি কথা বলিবার আছে। এক, প্রশাসনের নির্দেশ ব্যতীত পুলিশি বাড়াবাড়ি ঘটিতে পারে না, সকলেই জানে, তবে নূতন ভাবে জানা গেল যে প্রশাসনের শীর্ষমহলের কর্তৃত্ববাদিতা কী দ্রুততায় ও অভ্রান্ততায় পুলিশ ও প্রশাসনের নীচের মহলে চারাইয়া যাইতে পারে। যোগী আদিত্যনাথের এক-একটি উস্কানিমূলক বাক্যের সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসনের ব্যবহার প্রায় সরলরৈখিক ভাবে যুক্ত, ভবিষ্যৎ গবেষণা দেখাইয়া দিবে। হাথরসের বাড়াবাড়ি ও দেশজোড়া সমালোচনার সামনে দাঁড়াইয়াও যোগী কিন্তু অদম্য। তাঁহার সুভাষিত: যে বিরোধীদের প্ররোচনাতে এত সব ঘটিতেছে, পার্টি কর্মীরা যেন তাহাদের উচিত শিক্ষা দেয়।
দুই, উত্তরপ্রদেশের বর্তমান প্রশাসনের মধ্যে আজ প্রবল অসহিষ্ণু সংখ্যাগুরুবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্য কেবল নিহিত নয়, অতি গভীরে প্রোথিত ও প্রকাশ্যে উড্ডীয়মান হইতেছে। জাতপাত-অধ্যুষিত, জাতদ্বন্দ্বে দীর্ণ সমাজে আজ ব্রাহ্মণ্যবাদ মহা আক্রোশে নিজেকে নূতন জিঘাংসায় জাহির করিতেছে। দলিত গ্রাম হাথরসের দলিত বাল্মীকি সম্প্রদায়ের প্রতি পুলিশের মনোভাব সেই আক্রোশেরই স্পষ্ট পরিচায়ক। ইহা আকস্মিক নহে, অপ্রত্যাশিত তো নহেই, উত্তরপ্রদেশের সমাজ আজ ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের দৃপ্ত পরীক্ষণাগার। এবং পুলিশবাহিনী সেই পরীক্ষণ-প্রবাহের প্রধান পরিচালক।
তবে কি না, ভারতীয় সমাজ এমনই একটি জটিল বস্তু যে সংখ্যাগুরুর নামে এই পরিমাণ যথেচ্ছাচার চলিতে পারে, না কি সময় বুঝিয়া তাহাতেও রাশ টানিতে হয়, তাহা এখনও দেখিবার বিষয়। হাথরস-কাণ্ডের জেরে বিজেপির নীরব সমর্থক দলিত নেত্রী মায়াবতী তাঁহার আওয়াজ শুনাইতে বাধ্য হইয়াছেন। বিজেপি শীর্ষনেতারা খামখাই যোগী আদিত্যনাথের উপর বিরক্ত হইতেছেন না। বিজেপির সংখ্যাগুরুতন্ত্রকে টানিয়া এক বিপজ্জনক অতিরেকের দিকে লইয়া যাইতেছেন যোগী। সেই অতিরেক হইতে পিছু হটিতে হইবে কি না, তাহাই প্রশ্ন। তেমনটি ঘটিলে, যোগী ও তাঁহার হাথরস অধ্যায়ের নাম স্মরণীয় হইয়া থাকিবে, সন্দেহ নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy