Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

হাতের লেখাই বর্ষার অস্ত্র হয়ে উঠেছে

২০১৮ সালে বর্ষা পাড়ি দেয় মধ্যপ্রদেশের ইনদওরে। সেখানে আয়োজিত ‘হ্যান্ডরাইটিং অলিম্পিয়াড’ প্রতিযোগিতায় সারা ভারতের প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামে বর্ষা। সেই প্রতিযোগিতার ‘এ’ বিভাগে সে প্রথম স্থান অর্জন করে। লিখছেন বিশ্বরূপ দাস ২০১৮ সালে বর্ষা পাড়ি দেয় মধ্যপ্রদেশের ইনদওরে। সেখানে আয়োজিত ‘হ্যান্ডরাইটিং অলিম্পিয়াড’ প্রতিযোগিতায় সারা ভারতের প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামে বর্ষা। সেই প্রতিযোগিতার ‘এ’ বিভাগে সে প্রথম স্থান অর্জন করে। লিখছেন বিশ্বরূপ দাস

লেখায় মগ্ন বর্ষা। ছবি: উদিত সিংহ

লেখায় মগ্ন বর্ষা। ছবি: উদিত সিংহ

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৯ ০১:৪০
Share: Save:

ভাল এবং সুন্দর জিনিসের কদর সব সময় থাকে। শিল্প থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, খেলাধুলো, সাহিত্য— সর্বত্রই সুন্দরের জয়জয়কার। বিনোদনের ক্ষেত্রগুলিও সুন্দরের পুজোয় মগ্ন। সুন্দরের কারণে আমাদের চেতনার রঙে পান্না হয়ে ওঠে সবুজ, চুনী হয়ে ওঠে রাঙা। অর্থাৎ সুন্দর জিনিস প্রকৃতপক্ষে সুন্দর হয়ে ওঠে দর্শকের বা শ্রোতার মনের দৃষ্টিতে। তবে বাইরের সৌন্দর্যও একেবারেই উপেক্ষণীয় নয়। কারণ, বাইরের সৌন্দর্যও অনেকের মতে মৃগনাভীর মতো যোজনগন্ধা। পুষ্পের মতোই তার সৌরভ দূর, দূরান্ত থেকে পাওয়া যায়। যেমন ফুলের সৌন্দর্যের আকর্ষণে ছুটে আসে মৌমাছিরা। তেমনই সৌন্দর্যের টানে এসে উপস্থিত হন যথার্থ শিল্পরসিকেরা।

ঠিক এমনই এক সৌন্দর্যের কথা আজ আপনাদের বলব। এ এক শিল্পীর কথা। যার কাছে লেখার প্রতিটি অক্ষর যেন সাধনার প্রকাশ। তাঁর হাতের লেখার সৌন্দর্য দেখলে যে কেউ সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যাবেন বলে দাবি করেন অনেকে।

আজকের বিশ্বায়ন ও প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ের যুগে আমরা সকলেই একে অপরকে অতিক্রম করার নেশায় মগ্ন। অভিভাবকদের কেউ চাইছেন তাঁদের সন্তানকে ডাক্তার বানাতে, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার বানাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। এমন সময়েই পূর্ব বর্ধমান জেলার সদর শহর বর্ধমানের পাঁচ নম্বর ইছলাবাদের বাসিন্দা বর্ষা দত্তের মতো পড়ুয়ারা কিছুটা ভিন্ন পথের পথিক। বর্ষা এখন বর্ধমানের সেন্ট পলস অ্যাকাডেমির দশম শ্রেণির ছাত্রী। কিন্তু সে ভালবেসেছে বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালাকে। বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষর তার কলমের তুলিতে উঠে আসে শিল্পীর ছবির মতো। সেই পথ ধরেই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছে সে। রসদ খুবই সামান্য। তাঁর এই লড়াইয়ের গল্পে কোনও নাটকীয় উত্থান পতন নেই। পনেরো বছরের বর্ষার সম্বল বলতে কালি ও কলম। সেই কালি, কলমকে সম্বল করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বর্ষা সাদা কাগজের উপরে পটের মতো ফুটিয়ে তোলে তার সুন্দর লিখনশৈলী। তার হাতের লেখা দেখে অনেকেই বলেছেন, ‘কলমের ডগা থেকে যেন মুক্তো ঝড়ছে’।

বর্ষার লেখার নমুনা।

বর্ষার লেখার প্রত্যেকটি অক্ষর ছাপার অক্ষরের মতোই সুন্দর বলে দাবি তাঁর পরিবার ও স্কুল কর্তৃপক্ষের। তার লিখন-শৈলী দেখলে মনে হবে কেউ যেন ধরে ধরে টাইপ করেছে। অভিজ্ঞ লিপিশিল্পীর মতো তার সুন্দর হস্তাক্ষরের মাধুর্য প্রথমে তাঁর স্কুলের শিক্ষকদেরও নজরে এসেছিল। বর্ষা তখন সেন্ট পলস অ্যাকাডেমির অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সেই সময়েই তার শিক্ষকদের পরামর্শে বাবা, মা এবং শুভানুধ্যায়ীদের অনুপ্রেরণায় শুরু হল লেখার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই। লেখাপড়ার সঙ্গে সমান তালে চলতে লাগল হাতের লেখাকে আরও সুন্দর করে তোলার প্রয়াস। বর্ষা এই প্রচেষ্টায় সবসময় পাশে পেয়েছিল তার স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকাদের। উপহার হিসেবে ফ্রি স্টুডেন্টশিপ অর্থাৎ সারা জীবনের জন্য স্কুলের টিউশন ফি-মুকুব করে ওকে অনুপ্রাণিত করলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।

তার পরে বর্ষা পূর্ব বর্ধমান জেলার বিভিন্ন হাতের লেখার প্রতিযোগিতায় নিয়মিত যোগ দিতে থাকে। বেশ ক’টি প্রতিযোগিতায় সেরার শিরোপা পেয়ে সে তার লক্ষ্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উৎসাহ পেল। ২০১৮ সালে বর্ষা পাড়ি দেয় মধ্যপ্রদেশের ইনদওরে। সেখানে আয়োজিত ‘হ্যান্ডরাইটিং অলিম্পিয়াড’ প্রতিযোগিতায় সারা ভারতের প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামে বর্ষা। সেই প্রতিযোগিতার ‘এ’ বিভাগে সে প্রথম স্থান অর্জন করে। সে বছরই চণ্ডীগড়ে আয়োজিত ‘ওয়ার্ল্ড হ্যান্ডরাইটিং’ প্রতিযোগিতায়ও যোগ দেয় বর্ষা। সেখানেও সে প্রথম স্থান অর্জন করে।

২০১৯ সালে পড়াশোনার ভীষণ চাপের মধ্যেও মেয়েটি দ্বিতীয় বারের জন্য মধ্যপ্রদেশের ইনদওরে ছুটে গিয়েছিল ‘হ্যান্ডরাইটিং অলিম্পিয়াড’-এ যোগ দিতে। গত বারের মতো এ বারেও সে প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে।

পড়াশোনার পাশাপাশি, বর্ষার ভাল লাগে সাঁতার কাটতে। ছবি আঁকতেও খুব ভালবাসে বর্ষা। কিন্তু জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতার মঞ্চে হাতের লেখার মতো একটি বিষয়ে সাফল্য পেলেও প্রচারের আলো তাকে এখনও সে ভাবে স্পর্শ করেনি। জাতীয় স্তরে ভাল ফলাফল করার সুবাদে তার সামনে রয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরে হাতের লেখা প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার সুযোগও। বর্ষা স্বপ্ন দেখে, এক দিন হাতের লেখার জন্য সে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু পড়াশোনা করে হাতের লেখার প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার জন্য যে সময় এবং আর্থিক সামর্থ্যের প্রয়োজন হয় এখন তা তার নেই। কিন্তু এখানেই লড়াই থামাতে নারাজ বর্ধমানের বর্ষা।

পঞ্চপল্লি এমসি হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Hand writing
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy