Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

আগ্নেয়গিরির শিখরে

আগ্নেয়গিরির শিখরে বসিয়া তাঁহারা কোনও উত্তাপ বা আলোড়ন অনুভব করিতেছেন বলিয়া প্রত্যয় হয় না।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২০ ০০:৫৬
Share: Save:

অর্থশাস্ত্রী এবং সমাজ-রাজনীতির বিশ্লেষক অশোক রুদ্র প্রায় চার দশক পূর্বে বিপন্ন অর্থনীতি এবং উত্তাল রাজনীতির জঠরে বসিয়া আর্থ-সামাজিক সঙ্কট, বিশেষত বিপুল বেকারত্বের অগ্নিগর্ভ সম্ভাবনা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন: আগ্নেয়গিরির শিখরে পিকনিক। প্রবন্ধটি বহু-আলোচিত। তাহার শিরোনামটি কালজয়ী। কিংবা হয়তো বলা উচিত, কালের গতি আজও ওই শিরোনামকে অতিক্রম করিতে পারে নাই। এই মুহূর্তে দেশ ও দুনিয়ার পরিস্থিতি যেখানে পৌঁছাইয়াছে, তাহা বহু সচেতন নাগরিকের মনে নূতন করিয়া ওই শব্দবন্ধটিকে ফিরাইয়া আনিলে বিস্ময়ের কিছুমাত্র কারণ নাই। বিশেষ করিয়া, এই দেশের রাজধানীতে শাসকের গদিতে যাঁহারা অধিষ্ঠিত, তাঁহাদের কথা শুনিলে এবং কাজ (বা কাজের অভাব) দেখিলে মনে হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, তাঁহারা এই দুর্দিনে দিব্য নিশ্চিন্ত রহিয়াছেন এবং ভাবিতেছেন, এই ভাবেই আর কিছু কাল কাটিবে, তাহার পর আবার অর্থনীতি জাগিবে, শিল্পবাণিজ্য দৌড়াইবে, আবার তাঁহারা কব্জি ডুবাইয়া তাঁহাদের নিজস্ব রাজনীতির কারবার জমাইবেন। কোভিড-এর কারণে এখন পিকনিকের সুবিধা নাই, কিন্তু আগ্নেয়গিরির শিখরে বসিয়া তাঁহারা কোনও উত্তাপ বা আলোড়ন অনুভব করিতেছেন বলিয়া প্রত্যয় হয় না।

ইহাকে উটপাখিসুলভ বলিলে অন্যায় হইবে। বালির আড়ালে মুখ লুকাইয়া বিপদকে অস্বীকার করিবার দুর্নাম ওই প্রাণীর আছে, কিন্তু জীববিজ্ঞানে তাহার কোনও স্বীকৃতি নাই— উহা নিছক দুর্নাম, গালগল্প, ‘ফেক নিউজ়’। বস্তুত, সজ্ঞানে বিপদকে অস্বীকার করিবার প্রবৃত্তি প্রাণিজগতে স্বাভাবিক ভাবে থাকিবার কোনও উপায় নাই, কারণ তেমন প্রবৃত্তি প্রজাতির টিকিয়া থাকিবার পরিপন্থী। আত্মঘাতী। মানুষ নামক যে প্রাণীটি জীবনের বিবিধ ক্ষেত্রে ক্রমাগত আপন প্রজাতিকে ধ্বংস করিবার প্রাণপণ চেষ্টা চালাইয়া যাইতেছে, একমাত্র তাহার পক্ষেই হয়তো এমন নির্বোধ নিশ্চিন্ততা ‘স্বাভাবিক’। অজ্ঞতা এবং শক্তিমোহের সমাহার এমন মানসিকতাকে কোথায় পৌঁছাইয়া দিতে পারে, তাহার চরম দৃষ্টান্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তিনি একমাত্র দৃষ্টান্ত নহেন। নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার সহকর্মীদের আচরণেও বিপদ না বুঝিবার লক্ষণ প্রকট।

বিপদ বুঝিলে তাঁহারা কোভিড-আক্রান্ত ভারতের শ্রমজীবী মানুষের আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় সম্পূর্ণ অন্য ধরনের চিন্তা এবং তৎপরতার পরিচয় দিতেন। দরিদ্র মানুষকে তাঁহাদের প্রাথমিক প্রয়োজনের সামগ্রী ও পরিষেবা এবং নগদ অর্থ সরবরাহ করিতে, যত দ্রুত সম্ভব ও যথাসম্ভব নিরাপদে কাজ করিবার সুযোগ দিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করিতেন। তাহাতে অর্থনীতিরও উপকার হইত, কারণ বাজারে চাহিদা বাড়িত, যে চাহিদার অভাব প্রতি মুহূর্তে আর্থিক সঙ্কটে ইন্ধন জোগাইতেছে। তাহা হয় নাই। সরকার কর্মী ও কর্মহীনদের কার্যত বাজারের হাতে ছাড়িয়া দিয়াছেন। অনাথ অর্থনীতির বিপদ দিনে দিনে বাড়িতেছে, বিপন্ন মানুষের অন্নদায় কঠিন হইতে কঠিনতর। ইহা সামাজিক স্থিতি ও শান্তির অনুকূল হইতে পারে না। আর্থিক ও রাজনৈতিক অন্যায় হইতে সঞ্জাত সামাজিক ক্ষোভ জমিতে জমিতে কী ভাবে ফাটিয়া পড়ে, তাহার অগণিত দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে, এই মুহূর্তে খাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাহার বিপুল প্রদর্শনী চলিতেছে। চার দশক আগে অশোক রুদ্র লিখিয়াছিলেন, ‘দেশময় এই লক্ষ লক্ষ বেকারেরা একটি অগ্নিগর্ভ পর্বতের মত’। এবং সতর্ক করিয়াছিলেন: ‘সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যেকোন মুহূর্তে জেগে উঠতে পারে’। ভারতের বর্তমান শাসকদের নিকট মানবদরদ, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি মহান চিত্তবৃত্তির প্রত্যাশা হয়তো আজ আর কেহ করে না, কিন্তু ক্ষমতার মোহে বাস্তববোধ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত না হইলে তাঁহারা আগ্নেয়গিরির অন্তর্নিহিত আলোড়ন টের পাইতেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy