Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
অন্ন দিতে হবে, দিতে হবে কাজও, যাতে মানুষ মর্যাদা ফিরে পান
lockdown

প্রাণের দায়, মানের দায়

রকার ক্ষুধিতদের পাঠিয়ে দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে! বস্তুত, সহনাগরিকরা এগিয়ে না এলে আরও কত লোককে যে না খেয়ে মরতে হত, ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়।

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২০ ০১:২৬
Share: Save:

অসুখটা মারাত্মক। কিন্তু কোভিড-১৯ যতটা ক্ষতি করতে পারত, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি আমাদের হয়ে গেছে। এবং সেটা দেশের সরকারের উদ্যোগে। ভারতের মানুষ আজ মনুষ্যেতর। কোটি কোটি লোক যারা হাত লাগিয়ে উপার্জন করে ভাত খেতে পারে তাদের হাত পেতে ভাত চাইতে হচ্ছে। সরকার দিলে তবু সে ভাতে তার একটা অধিকারবোধ থাকে: ‘আমার ঘামে রক্তে অর্জিত ধন থেকে কিছু অংশ সরকার আমার জন্য খরচ করছে’। কিন্তু, সরকার ক্ষুধিতদের পাঠিয়ে দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে! বস্তুত, সহনাগরিকরা এগিয়ে না এলে আরও কত লোককে যে না খেয়ে মরতে হত, ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। অথচ, সরকারের ঘরে খাদ্যের বিপুল সম্ভার। সরকার চাইলেই, আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠা মহাধনীদের ওপর সামান্য কর চাপিয়ে প্রতিটি মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে। বিনি মাংনায় কেউ চাইছে না, সবাই মেহনত করেই খেতে চাইছে। কিন্তু সরকারকে যেন অমানবীকরণের নেশায় পেয়েছে: ভিনরাজ্যে খেটে খেতে যাওয়া লক্ষ লক্ষ লোককে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। চার ঘণ্টার নোটিসে রেল, বাস, যাবতীয় পরিবহণ স্তব্ধ করে দেওয়া হল। সে লোকগুলোর তো কিছু নেই, কেবল ঘরটুকু আছে। সেই গৃহকোণে অধীর প্রতীক্ষায় তার মা-বাপ-বৌ-বাচ্চা। দেহে অবিশ্রাম ক্ষুধার চাবুক, আর মনের ওপর হাজার মণ পাথরের ভার নিয়ে বিভুঁইয়ে পড়ে থাকার মানে তো বন্দিত্ব। যদিও বা দেড় মাস পরে ঘরে ফেরার একটা আশা দেখা গেল, নানা নাটকের পর তাঁদের জন্য ট্রেন চালানো শুরু হল, সরকারের মাইবাপ ফড়িয়াদের চাপে, তাদের আধুনিক দাসত্ব থেকে মুক্তির আশাও দূরে চলে যাচ্ছে: কর্নাটকে শুরু, কিন্তু ভিন্নত্র ফড়িয়ারা নিষ্ক্রিয় থাকবে এমনটা ভাবা কঠিন। মালিকদের ভয়, মজুররা যদি এক বার দেশে ফেরে সহজে হয়তো আর ভিনরাজ্যে যাবে না। মজুর তো মজুর মাত্র, তার মন বলে কিছু হতে পারে না, অতএব তাদের আটকে রাখো। পৌনে দুশো বছর আগে কার্ল মার্ক্স যে-রকমটা দেখেছিলেন: ততটুকুই বাঁচিয়ে রাখো যতটুকু না হলেই নয়। যারা নিতান্ত ফিরবেই, ফিরুক পায়ে হেঁটে, এবং রাস্তায় মারা যাক, যেমনটা গেল বারো বছরের মেয়ে জামলো মকদম। কোথাও তাদের হিসেব থাকবে না, মরার সময় দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলবার কেউ থাকবে না। অথচ, জীবনকে কেবল লাভ আর লোকসানের কারবার হিসেবে দেখার চশমাটা চোখ থেকে সরিয়ে দিলেই বোঝা যেত, এই মানুষগুলো সমাজের বোঝা নয়, সম্পদ, তাঁদের সাহায্যে, শ্রমে ও দক্ষতায় নতুন সমাজ গড়ার বিপুল সম্ভাবনা ছিল এবং আছে।

এমনিতেই এই দেশে মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার পথে বাধা অশেষ। শিক্ষার সুযোগ নেই, স্বাস্থ্যের সুযোগ নেই, কাজের সুযোগ নেই। তারই মধ্যে লোকে নিজের নিজের মতো করে বেঁচে থাকার এবং, যত শ্লথগতিতেই হোক, নিজেকে পূর্ণমানব হিসেবে গড়ে তোলার যে পথগুলো তৈরি করে আসছিলেন, কর্তাদের হুকুমে সেগুলো সব বন্ধ হয়ে গেল। কর্তারা ভাবলেন, এক্ষুনি সব কিছু বন্ধ না করে দিলে, পৃথিবী রসাতলে যাবে। অতএব, দেশ স্তব্ধ। কর্তাদের এটা অভ্যাস। ২০১৬-র নভেম্বরে রাতারাতি নোটবন্দি করলেন। কার কী লাভ হল কে জানে, হাজার হাজার অসহায় মানুষ ব্যাঙ্কের সামনে ধুলোয় গড়াগড়ি খেলেন, নিছক কাতারে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু প্রাণ গেল। মনুষ্যত্বের এই ঘোর অপমানে যে ক্ষতি, তার পূরণ হবে কী ভাবে? কী ভাবেই বা পূরণ হবে সেই অপমানের, প্রাণ বিসর্জনের, যা ঘটল নাগরিকত্বের অশ্লীল পরীক্ষায়? অত ভাবলে কর্তাদের চলে না। তাঁদের ভাবনা নিজেকে ঘিরে, তাঁদের হুকুমে মানুষ থালা বাজাচ্ছে, নিজেদের আরও অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে— এই সব গভীর অসুখ দেখে তাঁদের সুখ, মানুষের অপমানে তাঁদের পরিতৃপ্তি।

অসুখের মোকাবিলা একপ্রকার হচ্ছে। বস্তুত, বহু প্রকারে হচ্ছে। অদ্ভুত এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, এখানে রোগ মোকাবিলার প্রধান দায়িত্ব রাজ্যের, কিন্তু মাতব্বরি করে যাচ্ছে ভারত সরকার। আর্থিক দায় মূলত রাজ্যের কাঁধে, কিন্তু তাদের স্বাধীন ভাবে কাজ করার ক্ষমতা প্রায় নেই। তার মধ্যে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের অগ্রাধিকার আলাদা, কেরলের মতো মানবকেন্দ্রিক দর্শন বা ইতিহাস তো সবার নেই। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে রোগ মোকাবিলায়, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলায়, দেশান্তরী মজুরদের ফেরত আনায় সরকারের উদ্যোগ কম, কিন্তু খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে আগ্রহ স্পষ্ট। সরকারের ঘোষণা, রাজ্যের প্রায় ৭ কোটি ৮৫ লক্ষ মানুষকে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর, ছ’মাস বিনা মূল্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যান্ন দেওয়া হবে। খাদ্যের পরিমাণ অবশ্য নির্ভর করবে তাঁরা রেশনের কোন শ্রেণিভুক্ত তার ওপর (অন্ত্যোদয় হলে পরিবার পিছু ৩৫ কেজি; প্রায়রিটি হাউসহোল্ড হলে পূর্ণবয়স্ক পিছু মাসে ৫ কেজি, ইত্যাদি)। ২৬ মার্চের ঘোষণাটি এপ্রিলেই কার্যকর হয়েছে। রেশন নিয়ে নানা সমস্যার খবর আসছে, তবে সরকার ও জনসাধারণ সজাগ থাকলে এই সমস্যাগুলো দূর করা খুব কঠিন নাও হতে পারে।

আরও পড়ুন: এ পঁচিশে বৈশাখ উৎসব থেকে অনুভবে ফেরার

কিন্তু, কেন্দ্রের চাপিয়ে দেওয়া আর্থিক স্থবিরতা দূর হওয়ার আশা অন্তত নিকট ভবিষ্যতে নেই। কত দিনে উৎপাদনে গতি ফিরবে, বাজারের স্বাস্থ্যোদ্ধার ঘটবে, বলা কঠিন। অথচ, বিনা মূল্যে পাওয়া অন্নে প্রাণরক্ষা যদি বা সম্ভব, মানুষ হিসেবে উঠে দাঁড়ানো একান্ত কঠিন। নিয়ম অনুযায়ী বরাদ্দ অন্নে একটি পরিবার বড়জোর দশ-বারো দিন চালাতে পারে। এ-দিকে জীবিকার অন্য উপায় এখনও বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ দশ-বারো দিনের খাবারে পুরো মাস চালাতে হবে। দ্বিতীয়ত, এ-রাজ্যে বহু দিন ধরে কাজের ঘাটতি। লক্ষ লক্ষ মানুষ আজকের পরিস্থিতিতে নানা রাজ্যে আটকেও আছেন। লকডাউন উঠে যাবার পরেও অর্থব্যবস্থার চাকা ঘুরতে সময় লাগবে, তাই এ রাজ্যের মজুর সঙ্গে সঙ্গে অন্য রাজ্যে কাজ পাবেন, এমন ভরসা কম। খাদ্যের সংস্থান নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে এটাও বোঝা দরকার যে, যতটা প্রয়োজন তার এক তৃতীয়াংশের মতো দেওয়া যাচ্ছে, এবং সেটা কেবল খাদ্যান্ন, পুষ্টির অন্যান্য উপাদানের জোগান অনিশ্চয়।

আরও পড়ুন: মানব-প্রজাতির এই সঙ্কটে পাশে আছেন রবীন্দ্রনাথ

রাজ্যের কোষাগারে ঘাটতি বিরাট। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এই সঙ্কটে মানুষের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য দরকার কর্মসংস্থানের সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া। জানি, খাদ্যের ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকুর জন্যই কোষাগার থেকে বহু টাকা বেরিয়ে যাবে। তার ওপর কর্মনিয়োজনের জন্য টাকা কোথা থেকে আসবে, সে-প্রশ্ন থাকবেই। কিন্তু তার উত্তর না খুঁজলেই নয়। অন্যান্য রাজ্য সরকার ও দলগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কেন্দ্রের ওপর অর্থের জন্য চাপ সৃষ্টি একটা গুরুত্বপূর্ণ পথ। পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে বিভিন্ন পথের সন্ধান করা যেতে পারে। মোদ্দা কথা, রাজ্যের মানুষকে অবিলম্বে কাজ দিতে হবে। পাটিগণিতের দিকে সরকার চিরকাল একটু বেশি ঝুঁকে থাকে, সেটা তুলনায় সহজ বলে। কিন্তু এই দুর্বিপাকে কঠিন অঙ্কগুলো না কষে উপায় নেই।

সরকারি হিসেবে, গত অর্থবর্ষে রাজ্যে ১০০ দিনের কাজ পেয়েছিলেন প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ, বছরে গড়ে ৩৪ দিনের কিছু বেশি ধরে মোট কর্মদিবস সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় সওয়া ২৭ কোটি। এ বছর সংখ্যাটা অন্তত তিন গুণ বাড়ানো দরকার। রাজ্যে এই প্রকল্পে নথিভুক্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় সওয়া এক কোটি (প্রতি পরিবারে গড়ে ২.৩৯ কার্ড, মোট নথিভুক্ত ২,৯৩,১২,৯৭৮)। এই পরিবারগুলোকে যদি গড়ে অন্তত দু’মাস কাজ দেওয়া যায়, তাঁরা খানিকটা সামাল দিয়ে দিতে পারবেন।

কেবল একশো দিনের কাজই নয়, কিছু উদ্ভাবনী কাজের কথাও ভাবা যায়। যেমন, সঙ্কটের কারণে দীর্ঘদিন বাচ্চাদের লেখাপড়া বন্ধ। শিক্ষকদের নেতৃত্বে স্থানীয় কিছু ছেলেমেয়েকে কিছু পারিশ্রমিকের বদলে সেই পড়াশোনা বজায় রাখতে বলা যায়। জনস্বাস্থ্যের বহু বকেয়া কাজ শেষ করতে স্থানীয় শিক্ষিত যুবাদের সাহায্য নেওয়া যায়। প্রথাগত খোপের বাইরে বেরিয়ে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে কী ভাবে মানবিক মর্যাদাকে অমূল্য করে তোলা যায়। এতটাই মূল্যবান, যেন সব থেকে অসহায় মানুষটিরও এক বারের জন্য মনে না হয় যে, তিনি কারও কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নিচ্ছেন, তিনি যেন ভাবতে পারেন যে তিনি যা পাচ্ছেন তাতে তাঁর পুরো হক আছে বলেই পাচ্ছেন। এই মূল্যবোধ অর্জন করতে সময় লাগবে। কিন্তু, চেষ্টা করলে তবেই অর্জনের প্রশ্ন ওঠে।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Lockdown Foods Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy