“বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্ত দর্শন, এ-সম্বন্ধে এখন আর মতদ্বৈধ নাই। মিথ্যা হইলেও হিন্দুদের কাছে এই দুই দর্শন অসাধারণ শ্রদ্ধার জিনিষ। সংস্কৃতে যখন এগুলি শিখাইতেই হইবে, ইহাদের প্রভাব কাটাইয়া তুলিতে প্রতিষেধকরূপে ইংরেজীতে ছাত্রদের যথার্থ দর্শন পড়ানো দরকার।” — বলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যুক্তিবাদী এই মানুষটি ধর্মের বিপদ সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত শিক্ষাই ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য। স্ত্রীশিক্ষা, বিধবা-বিবাহের মতো যুগান্তকারী কর্তব্য পালনে তিনি অগ্রণী ছিলেন। বিধবা-বিবাহ নিয়ে রাজা রাধাকান্ত দেবের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। কিন্তু বিদ্যাসাগরই সফল হয়েছিলেন।
এ হেন বিদ্যাসাগর যে উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক দলের লক্ষ্য হবেন, এ তো বলাই বাহুল্য। তাই খাস কলকাতায় বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত মহাবিদ্যালয়ে ঢুকে তাঁর প্রস্তরমূর্তি ভেঙে দিল ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট বাহিনী। কলকাতা প্রতিরোধ করতে পারেনি। অথচ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিল, গোলমাল হতে পারে। কলকাতার আগে এই ফ্যাসিস্ট বাহিনী ত্রিপুরায় ভেঙেছে লেনিন ও সুকান্তের মূর্তি। মূর্তি হোক বা জীবন্ত মানুষ, যা তাদের অপছন্দ, তাকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছে তারা। ইতিউতি প্রতিবাদ হয়েছে বটে, কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি কলকাতা তথা বাংলা তথা ভারতের নাগরিক সমাজ। সে হিসাবে বাঙালি তথা ভারতীয়দের এ এক বিশাল পরাজয়।
বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ তো প্রস্তরমূর্তি, নির্জীব। প্রতিদিন নিয়ম করে ভাঙা হচ্ছে সনাতন ভারতের, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের জীবন্ত মূর্তি। কী ভাবে তা সকলেই কমবেশি জানেন। মানুষের যে বৃহত্তর পরিচয়, তাকে সঙ্কুচিত করে, অস্বীকার করে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আর এই খণ্ডিত পরিচয় নির্মাণ করে হানাহানি, বিদ্বেষ ও হিংসা সুপরিকল্পিত ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সংখ্যালঘু ও দলিতদের অস্তিত্ব পড়ছে প্রশ্নচিহ্নের মুখে। ভারতের সহিষ্ণু উদার মূর্তি ভেঙে খানখান করছে যে দলটি, তারাই ১৪ মে কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। কিন্তু এই ভাঙন তো শুরু হয়েছে অনেক দিন আগেই। আমরা ভাবের ঘরে খিল এঁটে শুয়েছিলাম কিংবা মনে মনে বহু আগেই যোগ দিয়েছিলাম ওই হানাদারদের পক্ষে। কেননা হানাদার বাহিনীর রাজনৈতিক এজেন্ডাই আমাদের অনেকের মনোগত আদর্শ। অনেকেরই মনে সুপ্ত ছিল ওই একই ঘৃণা ও বিদ্বেষ।
সাহেবরা যে সময়ে আমাদের দেশে বার্কলের ভাববাদী দর্শন পড়াতে বলেছেন, সেই সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র গণিত, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভূগোল ও বস্তুবাদী দর্শন পড়ানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন। এটা ঘটেছে এখন থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। অন্য দিকে শাসক দলের সদস্য, নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী বর্তমান সময়ে সওয়াল করছেন ধর্মশিক্ষার পক্ষে। দেড়শো বছর আগে বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয়’ ও ‘বোধোদয়’-এ ঈশ্বর বা পরলোকের প্রসঙ্গ তোলেননি। এ নিয়ে সাহেবদের ঘোরতর আপত্তি ছিল। কেউ কেউ তাঁর লেখা বই মিশনারি বিদ্যালয় থেকে তুলে দেওয়ার ফতোয়া জারি করেন। ঈশ্বরচন্দ্র জবাবে বলেছিলেন, তিনি ইচ্ছা করেই ঈশ্বর ও পরলোকের প্রসঙ্গ বাদ দিয়েছেন কেননা নীতিশিক্ষায় তার কোনও দরকার নেই, পড়ুয়ারা বস্তুবাদী হতে শিখুক। যদিও পরবর্তী কালে ‘বোধোদয়’-এ ঈশ্বর-প্রসঙ্গ ঢোকাতে এক রকম বাধ্য হন বিদ্যাসাগর। প্রসঙ্গত, ‘বোধোদয়’-এর মূল ইংরেজি ‘Rudiments of Knowledge’ বইয়ে এই সব প্রসঙ্গ ছিল। ইচ্ছে করে, পড়ুয়াদের মঙ্গলের কথা ভেবে, জাতির হিতসাধনে ঈশ্বরচন্দ্র সেগুলো বাদ দিয়েছিলেন।
এমন মনীষীকে ধর্মান্ধ, অসহিষ্ণু বাহিনী আক্রমণ করবে না, তা কখনও হয় নাকি! মূর্তি ভেঙে গেলে আবার তা বানিয়ে নেওয়া যায়; অপমান, ক্রোধ ও বেদনা আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকে। কিন্তু ক্ষমতায় আসীন একটি দল যে ভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ভাবে দেশকে ঠেলে দিয়েছে বহু যোজন পিছনে, সেই দলের পক্ষে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা অনেকটা সন্ধেবেলায় প্রদীপ জ্বালানোর আগে সকালবেলায় সলতে পাকানোর মতো। তারা তো প্রদীপের আলো চায় না, কেবল চায় হিংসার আগুন ছড়াক।
বিদ্যাসাগরের জীবনীকার বিহারীলাল সরকার লিখেছিলেন, “দুঃখের বিষয় অধ্যাপকের বংশে জন্ম লইয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়া, হৃদয়ে অসাধারণ দয়া, পরদুঃখ কাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া হিন্দু শাস্ত্রের প্রতি, হিন্দু ধর্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন? ইহাতে হিন্দুর অনিষ্ট হইয়াছে। হিন্দু ধর্মে আঘাত লাগিয়াছে। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশধর বিদ্যাসাগর উপনয়নের পর অভ্যাস করিয়াও ব্রাহ্মণের জীবনসর্বস্ব গায়ত্রী পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন”।
বিবেকানন্দও বিদ্যাসাগরের ঈশ্বর-ভাবনা সম্পর্কে প্রসন্ন ছিলেন না। ঈশ্বরচন্দ্র ‘বোধোদয়’ বইয়ে ঈশ্বরকে ‘নিরাকার, চৈতন্যস্বরূপ’ রূপে বর্ণনা করেন। অনেকের মতেই, তা স্বামীজির পছন্দ ছিল না। একটি আড্ডায় তিনি বিদ্যাসাগরের লেখা সম্পর্কে বলেছিলেন, “ঈশ্বর ‘নিরাকার, চৈতন্যস্বরূপ’, ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’— ওতে কোনো কাজ হবে না, ওতে মন্দ বই ভাল হবে না।” অথচ স্বামীজির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ভাল ছিল। স্বামীজিকে বিদ্যাসাগর মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন বৌবাজার শাখায় প্রধান শিক্ষকের চাকরি দিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবা-বিবাহ আন্দোলন নিয়ে বিবেকানন্দের তেমন উৎসাহ ছিল না। তা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরের মতো প্রতিভাকে তিনি তাঁর গুরু রামকৃষ্ণের পরেই স্থান দিয়েছিলেন। কেননা ঈশ্বর না মানলেও বিদ্যাসাগর জগতের হিতের কথা বলতেন।
এত কথা বলার হেতু একটিই। সেটি হল— বিদ্যাসাগর তাঁর নিজের সময়ের থেকে বহু এগিয়ে ছিলেন। এমনকি এখনও তাঁর প্রবল খরতাপ সহ্য করার মতো ক্ষমতা ভারতীয়দের হয়নি। তাই কিছু গুন্ডা এসে যখন তাঁর মূর্তি ভেঙে দিয়ে যায় তখন বুঝতে হবে, এই ধর্মনিরপেক্ষ মনীষী আসলে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের শত্রু। প্রতিরোধ গড়ে না উঠলে এদের প্রচ্ছন্ন বা প্রকট সমর্থক হিসাবে বাঙালি নিজেকেও এক দিন ক্ষমা করতে পারবে না। বিদ্যাসাগর শুধু বাঙালির নন, সারা দেশে তাঁর সামাজিক প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। ভগিনী নিবেদিতাকে স্বামীজি একবার বলেছিলেন, “উত্তর ভারতে আমার বয়সি এমন কোনো লোক ছিল না, যার উপর তাঁর (বিদ্যাসাগরের) ছায়া পড়েনি।”
আজ কেন তবে কেন কিছু লোক এসে বিদ্যাসাগরের প্রস্তরকায়া চুরমার করে দিল? আমাদেরও কি তারা আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল না?
(উদ্ধৃতির মধ্যে মূল বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)
রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির, বেলুড় মঠের দর্শন বিভাগের প্রধান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy