বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উঠলেই সাধারণ সাহিত্য-পাঠকের মনে প্রথমেই মনে আসে ‘পথের পাঁচালী’র কথা। শিশু আর কিশোর পাঠকদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা চাঁদের পাহাড়ের জন্যই।
সাধারণ পাঠকের কাছে তিনি একজন নিষ্ঠাবান প্রকৃতি প্রেমিক। বড় মাপের কথা সাহিত্যিক। কিন্তু এই উত্তাল সময়ে তাঁকে নিয়ে চর্চার যে আরও প্রয়োজন সেই তাগিদ বিশেষ লক্ষ্য করা যায় না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে মহান সুর ফুটে উঠেছে নানাভাবে তা প্রায় উপেক্ষা করে যাই আমরা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুর বলতে কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম উচ্চারণ হয়। কিন্তু এই দুঃসহ সময়ে যখন সাম্প্রদায়িক বিভাজন প্রকট হয়ে উঠেছে তখন বিভূতিভূষণের রচনাও আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। তৎকালীন ভারতবর্ষের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করতে হিন্দু-মুসলমান সবাই হাতে হাত মিলিয়ে লড়ছে। কিন্তু বিভেদকামী ইংরেজ সরকার এই লড়াইয়ের ভীতকে দূর্বল করে তোলার জন্য উঠে পড়ে লাগে। ব্রিটিশ সরকারের এই চাল বানচাল করার জন্য একযোগে সম্প্রীতির সুর শোনা গিয়েছিল মহাত্মা গাঁধী, নেতাজি সুভাষ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের মুখে। তাদের এই প্রচেষ্টা সর্বজনবিদিত এবং স্বীকৃত। কিন্তু এই বিষয়ে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যাযয়ের অবদানটুকু স্বীকার না করা বোধহয় বড় ভুল।
তাঁর জীবনের নানা ঘটনার কথা পড়লে জানা যায় তিনি কীভাবে মুসলমানদের জীবনযাপনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন ‘সে বার ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে.....’ স্বাভাবিক ভাবেই এই একটি লাইনের ভেতরেও ফুটে ওঠে ভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানকে কীভাবে নিজের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করে তুলেছিলেন।
বিভূতিভূষণ জীবন ও সাহিত্য চিন্তার মিলিত ফসল হল ‘আহ্বান’ গল্পটি। গ্রামের মুসলিম বিধবা জমির করাতির স্ত্রী গল্পের কথককে ভীষণ ভালোবাসে। সেই মহিলার ইচ্ছে তার মৃত্যুর পর কথক তার কবরে মাটি দেবেন। এই গল্পে রয়েছে যে দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়ে আসার পর যখন তিনি গ্রামে ফিরলেন দুর্ভাগ্যজনক হলেও সে দিনই করাতির স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেলেন। কথক তার কবরে মাটিও দিলেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে মানুষের আবেগ-ভালোবাসা, আন্তরিকতার মূল্য ধর্ম নামক গণ্ডীর কাছে তুচ্ছ। এই মানবিকতা বোধের শিক্ষা আমরা বিভূতিভূষণের কাছে বারেবারে পাই।
মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কাছে যে ধর্মের মূল্য নেহাত তুচ্ছ তার প্রমাণ আরেকটি গল্প ‘অন্তর্জলী’। এই গল্পে দেখা যায় হিন্দু দীনদয়াল মারা যাচ্ছেন বলে বহুদূর থেকে নিজের কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন কাশেমালি। আসার সময় নিজের এলাকা থেকে তিনি একজন কবিরাজকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন যদি দীনদয়ালকে বাঁচানো যায়। কাশেম আলির আশঙ্কা যে দীনদয়াল মারা গেলে হিন্দু ধর্মের এক জন পালা গান বাঁধার উৎকৃষ্ট মানুষ কমে যাবে। হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এও এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ‘সিঁদুর চরণ’ গল্পটি পাঠককে দেখায় যে দূর দেশে গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের যুবক সিঁদুর চরণের সাথে তার গ্রামের আশেপাশের লোকজনের দেখা হতেই সিঁদুর চরণ জিজ্ঞাসা করে ‘মেহেরপুরের নসিবুদ্দি সেখেরে চেন?’
তিনি কিন্তু কোনও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের খোঁজ করেননি। এখানেই প্রমাণ পায় বিভূতিভূষণ কীভাবে নিখুঁত ভাবে হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির জাল বুনতে চেয়েছেন। এর পর বিদেশে যে লোকটি সিঁদুর চরণকে আপ্যায়ন করে, ভালোবেসে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দেন তিনিও একজন মুসলমানই।
‘মড়িঘাটের মেলা’ গল্পটি দেখায় যে মুসলমান মাঝি অক্রুর সেই হিন্দু তীর্থযাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে কতটা আগ্রহী। মেলাটি হিন্দুদের। বিভূতিভূষণ লিখেছেন মুসলমানদের ভিড় বেশি এই মেলায়।
সম্প্রীতির ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি অবশ্য কখনো তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অনুশাসনে আঘাত করেননি। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি লিখেছেন যে ‘গঙ্গাস্নান তারা অবশ্যি করে না’। এটা একদম সত্য কথা যে পূণ্য লাভের আশায় মুসলমানরা কখনওই গঙ্গা স্নান করে না। এ তো অন্য ধর্মের অনুশাসনের উপর লেখকের শ্রদ্ধাশীল
থাকার পরিচয়!
‘রূপো বাঙাল’ গল্পের নায়ক হল রূপো, মুসলমান। কিন্তু সে দীর্ঘদিন এক হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে থাকে। ২০ বছরেরও বেশি সময় সেই পরিবারের সাথে মিলেমিশে থেকে, সেই পরিবারের এক জন সদস্যের মত খেয়ে দেয়ে জীবন যাপন করে, সেখানেই তার মৃত্যু হয়। একই ছন্দে বাঁধা আরেকটি গল্প ‘কাঠ বিক্রি বুড়ো’। এক মুসলমান বৃদ্ধ কাঠ কিনতে এসে কথকের গ্রামে দীর্ঘ দিন থেকে যায়। কথকের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার প্রীতির সম্পর্ক। গ্রামের সদ্য-মৃত এক ফল বিক্রেতার বাড়িতে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের অসহায় পরিস্থিতি দেখে বৃদ্ধের চোখে জল এসে যায়। অন্যের অসহায় পরিস্থিতিতে মানুষ হিসেবে মানুষের চোখে জল এসে যায়। এ ক্ষেত্রে যে ধর্ম কোনও বাধা নয় এই গল্প তারই দৃষ্টান্ত। ‘বারিক অপেরা পার্টি’ গল্পে মুসলমান যুবক বারিক হিন্দু দেবতার পালা গান গেয়ে বেড়ায়। এটা তার কাছে নেশার মত।
‘মৌরিফুল’ বিভূতিভূষণের লেখা একটি বিখ্যাত ছোটগল্প। এই গল্পের পটভূমি এক হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবার। কাহিনির এক ফাঁকে বিভূতিভূষণ আতর আলি নামের এক মুসলিম ঘরামির ছেলের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। গল্পে দেখা যায় সেই হিন্দু ব্রাহ্মণ বাড়ির গৃহিণী সেই আতর আলিকে দয়াপরবশত একটি চাদর দিচ্ছেন। চাদরখানি লুকিয়ে দিলেও মুসলমান ছেলেটি হিন্দু ব্রাহ্মণ ঘরে ঢোকার জন্য
অচ্ছুৎ হয়নি।
যদিও সমাজে তখন উঁচু-নিচ ভেদাভেদ বিদ্যমান। হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ ইত্যাদি বিষয়ে নানান ছুতমার্গ। কিন্তু বিভূতিভূষণ এক দিকে যেমন তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থাকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন তেমনই ভাবে তিনি সেই চক্রব্যূহের থেকে বেরিয়ে আসার পথও বাতলে দিয়েছেন। এ রকম আরও নানান ছোটগল্প ও রচনা বিভূতিভূষণের ঝুলিতে রয়েছে, শুধুমাত্র দৃষ্টান্ত দেওয়ার স্বার্থে প্রবন্ধের আকার না বাড়ানোই শ্রেয়।
আর একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সাহিত্যে মুসলমান চরিত্র ও সমাজ ছিল অতিমাত্রায় ব্রাত্য। সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের কাছে এই বিষয়গুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় হিসেবে পরিগণিত হত। আর ব্রিটিশদের কাছে এই বিষয়গুলো তুরুপের তাসের মত কাজ করত। কিন্তু বিভূতিভূষণ এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাঁর লেখা রচনা এবং ছোটগল্পে মুসলমান চরিত্রের ছড়াছড়ি।
তাঁর লেখা ‘ফকির’ গল্পটি সম্পূর্ণ মুসলমান সমাজের পটভূমিতে রচিত। তার কিছু কিছু রচনায় মুসলমান সমাজের গভীর থেকে উঠে আসা কথোপকথন এবং শব্দের সঙ্গে তথাকথিত অনেক হিন্দু পরিবার পরিচিত নয়। প্রতিবেশিকে জানা এবং চেনার মধ্যে দিয়ে এই দূরত্বকে নৈকট্যে পরিণত করার যথেষ্ট প্রচেষ্টা ছিল বিভূতিভূষণের রচনায়।
এই সমস্ত রচনা এবং তার কথা শুনলে বোঝা যায় যে একজন মানুষ একটি সমাজের কতটা গভীরে প্রবেশ করলে তবে মানুষের প্রতি এরকম ভালবাসা জন্মায় নিজের জীবন ও লেখায়। আর কে না জানে কোনও মানুষকে সম্পূর্ণ ভাবে চেনার মধ্যে দিয়ে যে বিভেদ এড়ানো যায় দূর থেকে দেখলে সেই বিভেদ কখনওই এড়ানো যায় না। বিভূতিভূষণ এই কাজটি আজীবন আড়ালেই করে গিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই দিকটি নিয়ে বিশেষ আলোকপাত করা হয়নি। অনালোচিতই রয়ে গিয়েছে তাঁর এই নিরলস প্রচেষ্টা।
(লেখক চিকিৎসক, মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy