মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম তথা দক্ষিণ-পশ্চিমে নেভাদা রাজ্যের লাস ভেগাস-এ পয়লা অক্টোবর রাতে আবার ভয়ংকর এক হত্যালীলায় অন্তত ঊনষাট জন নিরীহ মানুষের প্রাণ গেল। জখম পাঁচশোরও বেশি। আমেরিকার মতো হিংসাপ্রবণ দেশেও এ ঘটনা ঐতিহাসিক, এবং আধুনিক কালের ইতিহাসে এ যাবৎ সবচেয়ে মারাত্মক। এ যাবৎ।
খুনির নাম স্টিফেন প্যাডক। সে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। ইসলামিক স্টেট দাবি করেছে প্যাডক তাদের লোক, কিন্তু এফবিআই সে দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছে। অর্থাৎ, তথাকথিত ইসলামি সন্ত্রাসীদের কাজ নয় এটা। অন্তত এখনও পর্যন্ত যা খবর পাওয়া গেছে, তাতে মনে হয় প্যাডক একাই ম্যান্ডেলে বে হোটেলের বত্রিশ তোলা থেকে অটোম্যাটিক রাইফেল চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ খুন করেছে। তার পর নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। তার হোটেলের ঘরে তেইশটি বন্দুক ও রাইফেল পাওয়া গেছে। অদ্ভুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সন্দেহ নেই! হত্যাকাণ্ডের পরে তদন্তে নেমে পুলিশ প্যাডকের বাড়িতেও প্রচুর বন্দুক, পিস্তল, কার্তুজ ইত্যাদি খুঁজে পেয়েছে।
আমরা যারা আমেরিকায় বহু বছর আছি, আমাদের কাছে এই বন্দুকবাজি, গণহত্যা এখন প্রায় দৈনন্দিন খবর। আমরা এ সব খবর পড়ে আঁতকে উঠি, ঘটনার বীভৎসতায় বিবমিষা জাগে। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে কানেক্টিকাট-এর এক অজানা শহরের স্কুলে যখন এক বন্দুকবাজ বহু শিশুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, তখন বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট। আমরা ভেবেছিলাম, এ বারে নিশ্চয়ই এই রক্তপাত বন্ধ হবে। এই নির্বিচার শিশুহত্যা এ বারে নিশ্চয়ই সাধারণ মার্কিনিদের বিবেকে ঘা দেবে। মার্কিন কংগ্রেস অথবা প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই এ বারে মারণাস্ত্র-বিরোধী আইন পাশ করবেন। ২০১৫ সালের জুন মাসে যখন সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লস্টন-এর এক গির্জার মধ্যে বন্দুক নিয়ে ঢুকে এক খুনি প্রার্থনারত মানুষদের খুন করে চলে গেল, আমরা ভেবেছিলাম, এ বারে নিশ্চয়ই অতি-রক্ষণশীল দক্ষিণী আমেরিকানরাও এই বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। একটা জাতীয় জনজাগরণ হবে।
কিন্তু কিছুই হল না। বারাক ওবামার বাগ্মিতা যত দেখেছি আর অনুপ্রাণিত হয়েছি, তাঁর আট বছরের শাসনকাল ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কাজকর্ম আমাদের একেবারেই অনুপ্রাণিত করতে পারেনি। তিনি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অবশ্যই রিপাবলিকান পার্টির ভয়ংকর বিরোধিতা তার জন্যে অনেকাংশেই দায়ী। কিন্তু, বন্দুকবাজি বন্ধ করার জন্যে ওবামা অথবা ক্লিন্টনদের মতো ডেমোক্রেটিক নেতা ও নেত্রীদের কতটা সদিচ্ছা ছিল, তা নিয়ে তীব্র সংশয় আছে।
হ্যাঁ, বিল ক্লিন্টন ১৯৯৩ সালে ব্র্যাডি বিল নামক এক আইনে সই করেছিলেন বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। কেউ আমেরিকার ভয়ংকর এই জাতীয় সমস্যার সার্বিক সমাধান করতে তেমন ভাবে উদ্গ্রীব নয়। মিডিয়াতে একের পর এক এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার খবর মানুষকে আরও আতঙ্কিত, অসহায় করে তোলে। আতঙ্ক সৃষ্টি হয় বহু গুজবে। মানুষ ডিপ্রেশন-এর শিকার হয়। শিশুরা স্কুলে যায় মনের ভেতরে ভয় নিয়ে। যুবকযুবতীরা লাস ভেগাসের কান্ট্রি মিউজিক ফেস্টিভাল-এর মতো কনসার্টে যায় অজানা এক আশঙ্কা নিয়ে। তার পর, আস্তে আস্তে আবার সব থিতিয়ে পড়ে। মারণাস্ত্র ও তার অপরাধী ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয় না। ওয়ালমার্টে, শহর ও গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য ছোট-বড় দোকানে প্রকাশ্যে বন্দুক, রাইফেল, পিস্তল, গোলাগুলি বিক্রি হয়। অনেক রাজ্যে সে সব কেনার জন্যে ক্রেতার পরিচয় ও পূর্ব-কাহিনি তেমন ভাবে খতিয়ে দেখাও (ব্যাকগ্রাউন্ড চেক) হয় না। এই প্রবণতা গত কুড়ি পঁচিশ বছরে অনেক বেড়ে গেছে। আমেরিকা ফিরে গেছে অন্ধকার মধ্যযুগে।
আমেরিকার অতি শক্তিশালী সংগঠন ন্যাশনাল রাইফ্ল অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) এখন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা মার্কিন কংগ্রেসের বহু রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট সদস্যকে তাদের নির্বাচনী তহবিলে মোটা অর্থ দিয়ে থাকে। তার বিনিময়ে তারা কী পায়? তাদের বিরুদ্ধে, তাদের দেশজোড়া মারণাস্ত্র বিক্রি ও ব্যবসার বিরুদ্ধে কেউ যেন কোনও আইন পাশের উদ্যোগকে সমর্থন না করে। মিডিয়াতে যেন এই মধ্যযুগীয় গণহত্যা ও অস্ত্রব্যবসার বিরুদ্ধে কোনও প্রকার বিশ্লেষণমূলক আলোচনা না হয়, আমেরিকার তথাকথিত সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট নামক প্রাগৈতিহাসিক সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে কেউ যেন কোনও মৌলিক আলোচনা না করে, সে জন্যও তারা অত্যন্ত সক্রিয়। এই এনআরএ-র পিছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি-ধনিক কর্পোরেশনগুলো, বহুজাতিক মিডিয়া, এবং যুদ্ধ ও যুদ্ধাস্ত্র-ব্যবসায়ীরা। বস্তুত, তাদের হাতেই এখন আমেরিকার শাসনব্যবস্থা। ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্ট তো বটেই, বহু ডেমোক্র্যাট নেতা ও নেত্রীরাও এনআরএ-র মুক্তহস্ত আর্থিক অনুদানের লোভ সংবরণ করতে পারেন না। ম্যাক্স বকাস, টিম জনসন, জো মানচিনদের মতো ডেমোক্র্যাট সেনেটরদের এনআরএ তাদের সর্বোচ্চ (‘এ’) রেটিং দিয়েছে। লাস ভেগাস যে নেভাডা রাজ্যে অবস্থিত, সেখানে মারণাস্ত্র কেনাবেচার আইন সবচেয়ে শিথিল। ফল যা হওয়ার, হয়েছে।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy