Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

উত্তরের সম্প্রীতির মন্ত্র ধারণ করে চলেছে কোচবিহারের গারোপাড়া

বড়দিন আর নববর্ষে সেজে উঠবে ছোট্ট এই গ্রাম। মেতে উঠবে সম্প্রদায় নির্বিশেষে। চলছে তারই প্রস্তুতি। লিখছেন শৌভিক রায় রাজনগর কোচবিহার থেকে নয়-দশ কিলোমিটার দূরের নাটুয়ার পাড়ে এখন প্রস্তুতি তুঙ্গে। কারণ, আর কয়েকদিন পরেই বড়দিন এবং তারপর ইংরেজি নববর্ষ।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৩৮
Share: Save:

সত্তরোর্ধ্ব মিলন সাংমা বাড়িতে রঙের কাজ করাচ্ছেন। আশপাশের বাড়িগুলিতেও টুকিটাকি সারাই থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজ চলছে। রাজনগর কোচবিহার থেকে নয়-দশ কিলোমিটার দূরের নাটুয়ার পাড়ে এখন প্রস্তুতি তুঙ্গে। কারণ, আর কয়েকদিন পরেই বড়দিন এবং তারপর ইংরেজি নববর্ষ। সারা দেশের সঙ্গে উত্তরের অখ্যাত এই ছোট গ্রামটিও সেজে উঠবে। চোখধাঁধানো জমকালো উদ্‌যাপন না হলেও যত দিন যাচ্ছে এখানকার বড়দিন ও নববর্ষের উৎসব গোটা জেলাকে আকৃষ্ট করছে।

এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় ৭০টি পরিবার গারো জনজাতি সম্প্রদায়ের ও তাঁরা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত। বড়দিনে তাঁদের অনুষ্ঠান ঘিরে প্রতিবেশী বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম পরিবারগুলিও মেতে ওঠে। নাটুয়ার পাড় ও গারোপাড়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা অনুকরণযোগ্য।

‘আচিক মান্দে’, অর্থাৎ ‘পাহাড়ের মানুষ’ গারোরা অধিকাংশই মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের বাসিন্দা। তবে, অসম ও আমাদের রাজ্যের উত্তরেও গারো সম্প্রদায়ের মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। দেশভাগের আগে গারো পাহাড়ের সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের সুসং দুর্গাপুরে এঁদের বাসস্থান থাকলেও দেশভাগের পর তাঁরা এপারে চলে আসেন। এঁদের অধিকাংশই উত্তরের বনভূমি সংলগ্ন অঞ্চলের বাসিন্দা হলেও মনে করা হয় যে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি কোনও এক সময়ে তদানীন্তন কোচবিহার রাজ্যে ধর্মান্তরিত গারোরা জীবিকার সন্ধানে এসেছিলেন। সে আমলে কোচবিহার শহর লাগোয়া ঘুঘুমারিতে তাদের স্থায়ী নিবাস গড়ে ওঠে। আরও কিছু পর বেশ কিছু সংখ্যক গারো পরিবার দেওয়ানহাটের কাছের নাটুয়ার পাড় অঞ্চলে চলে এসে জঙ্গলাবৃত স্থানে বসতি গড়ে তোলেন। কালক্রমে জায়গাটি গারোপাড়া বলেই পরিচিতি লাভ করে।

শান্ত-ছিমছাম গারোপাড়ায় রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টানদের জন্য আলাদা আলাদা চার্চ রয়েছে। এর মধ্যে প্রোটেস্টান্টদের চার্চটি পুরনো এবং সুইডিশ মিশনের নিয়ন্ত্রণাধীন। কোচবিহারের ইতিহাসে সুইডিশ মিশনারিদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। কোচবিহারে নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য মহারানি সুনীতিদেবীর উদ্যোগে মধ্যপ্রদেশ থেকে ১৮৯৬ সালে সুইডিশ সেলাই-শিক্ষিকা লিডিয়া ম্যাগুনসনকে নিয়ে আসা হয়। সেই সময় মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের নিজস্ব ব্যান্ড পার্টিতে বেশ কিছু খ্রিস্টান পরিবার কাজ করলেও তাঁদের সন্তানদের জন্য সেভা বে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। ধর্মান্তরিত এই পরিবারগুলির জন্য লিডিয়া সুনীতিদেবীর কাছে আবেদন করেন। কোচবিহারে প্রশাসনিক ব্যাপারে ইংরেজ হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হলেও সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ধর্মের ক্ষেত্রে কোনও দিনই বিদেশি প্রভাবকে মেনে নেওয়া হয়নি। কিন্তু ধর্মান্তরিত এই মানুষগুলির জন্য শিক্ষার দরকার বুঝে শিক্ষাব্রতী সুনীতিদেবী মহারাজাকে প্রয়োজনীয় অনুমতির জন্য অনুরোধ করেন। শুধুমাত্র সুইডিশরা বাদে আর কেউ মিশনারি শিক্ষাবিস্তারে উদ্যোগী হবে না— এই শর্তে মহারাজা অনুমতি দিলে সুইডিশ মিশনারিরা গারো সম্প্রদায়ের পরিবারগুলি-সহ অন্যান্য ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের জন্য বিদ্যালয় ও চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী কালে নাটুয়ার পাড় অঞ্চলেও চার্চ স্থাপনে তাঁদের ভূমিকা ছিল। এই চার্চটি বাদে ১৯৮৫ সালে রোমান ক্যাথলিকদের চার্চটিও তৈরি হয়। রোজালি মালা জপতে জপতে মা মেরি-সহ যিশুর উপাসনা করা ছাড়া অবশ্য প্রোটেস্টানদের সঙ্গে তাঁদের বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় দুই চার্চেই আলাদা আলাদা করে প্রার্থনা হলেও সারা সপ্তাহে সবাই সবার সঙ্গে মিশে থাকেন।

গারো সমাজের দুই শাখা সাংমা ও মারাকের মধ্যে সাংমা শাখার চিসিক, বাংশাল ইত্যাদি উপশাখার মানুষদের আধিক্য বেশি আজকের গারোপাড়ায়। বড়দিন মানেই তাঁদের কাছে গারো পিঠে সহযোগে আনন্দের দিন। এই পিঠে আতপ চাল, গুড়, ও কলা একসঙ্গে মেখে কলাপাতায় ভাঁজ করে নির্দিষ্ট সময় জলে সেদ্ধ করা হয়। বিশেষ এই পিঠে বাদেও মাছ, মাংস রান্না করা হয়। তাঁদের নিত্যদিনের খাবারে বাঙালি স্পর্শ থাকলেও বড়দিনের সময়ের রসনা অন্যরকমের হয়। পরিবারগুলির সেনাবাহিনীতে থাকা সদস্যেরাও চেষ্টা করেন এই সময়টায় বাড়িতে ফিরতে।

কয়েকদশক আগেও দারিদ্র এঁদের নিত্যসঙ্গী ছিল। এখন অবস্থা অনেকটা বদলেছে। গারো পরিবারের মানুষেরা এখন সরকারি চাকরি, শিক্ষকতায় যোগ দিচ্ছেন। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এখানকার উচ্চ বিদ্যালয়টি তাঁদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ও। এখানকার গারো সমাজ পুরোপুরি মাতৃতান্ত্রিক না হলেও এই গ্রামের মহিলারা তুলনায় অনেক বেশি সাবলম্বী। ফলে, বিভিন্ন কাজে তাঁরা অগ্রাধিকার পান। পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁদের এগিয়ে চলা নিঃসন্দেহে তাঁদের আলাদা করেছে। সংসার ও গ্রামের বিভিন্ন ব্যাপারে মহিলাদের মতামত যথেষ্ট গুরুত্ব পায়।

আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও গারোপাড়ার গারোরা নিজেদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে নষ্ট হতে দেননি। গ্রামে কান পাতলেই শোনা যায় ভোট-বর্মী ভাষার অন্তর্গত তাঁদের নিজস্ব ভাষার গান। বড়দিনের সময় খ্রিস্টমাস ক্যারোল আর বিভিন্ন প্রার্থনা সঙ্গীতে চারদিক গমগম করে। আজকাল নিজেদের গানের রেকর্ডও করছেন তাঁরা। পোশাকের ক্ষেত্রেও বদল এসেছে। অতীতের গান্দ মাখাল বা গানা জাতীয় পোশাক আজ আর দেখা যায় না। বরং আধুনিক শহুরে পোশাকেই অভ্যস্ত তাঁরা। নিজেদের ভাষার লিপি না থাকাটা বেদনার হলেও গারোপাড়ার গারোরা নির্ভর করেন বাংলা লিপির উপর। অতীতে অবশ্য রোমান লিপিই ছিল তাঁদের শিক্ষার একমাত্র উপায়। কিন্তু বাংলা বা অন্য কোনও ভাষা তাঁদের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির পরম্পরাকে গ্রাস করতে পারেনি।

বৈচিত্রময় উত্তরের অভিজ্ঞান বহন করে চলেছে এই ছোট্ট গ্রামটি। প্রমাণ করে চলেছে যে, সদিচ্ছা থাকলে বিভিন্ন ধর্মের, ভাষার ও কৃষ্টির মানুষ নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেও সম্প্রীতির উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠতে পারেন।

(লেখক কোচবিহার মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Garos Garopara Cooch Behar Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy