হিংস্র অসহিষ্ণুতার অন্যতম বলি। কন্নড় লেখক ও বিদ্যাজীবী এম এম কালবুর্গি
ভা রতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে বিপজ্জনক আটটি বিষয়ের কথা আমি গত দুই পর্বে (‘মত প্রকাশের...’, ১৪-৬ এবং ‘ক্ষমতার স্বার্থ...’, ১৫-৬) লিখেছি: বস্তাপচা ঔপনিবেশিক আইন, আমাদের বিচারব্যবস্থার ত্রুটি, পরিচিতির রাজনীতির দাপট, বিভিন্ন দুষ্কর্মে পুলিশের যোগসাজশ, নানা রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সৎসাহসের অভাব, সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর ও তার পাশাপাশি বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের ওপর সংবাদমাধ্যমের নির্ভরশীলতা এবং লেখক, সম্পাদক, শিল্পী ও চলচ্চিত্রকারদের নানা মতবাদের বশীভূত হওয়া অথবা তাঁদের কেরিয়ারসর্বস্বতা। এই আটটি ব্যাধি ভারতীয় গণতন্ত্রের নৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় ঘুণ ধরিয়ে দিচ্ছে। চিন বা রাশিয়ার মতো আধা-স্বৈরতন্ত্রী দেশের তুলনায় আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকরা নিশ্চয়ই বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। কিন্তু সুইডেন বা কানাডার মতো পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের তুলনায় তাঁদের স্বাধীনতা অনেক কম।
২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে অসহিষ্ণুতা এবং লেখক-শিল্পীদের ওপর আক্রমণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, কংগ্রেস, বামপন্থী দল বা বিভিন্ন আঞ্চলিক দল যখন যেখানে ক্ষমতায় থেকেছে, কাউকেই বাক্স্বাধীনতা রক্ষায় তৎপর হতে দেখা যায়নি। ভারতে কোনও কালেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্বর্ণযুগ ছিল না। নেহরু-পটেল-অম্বেডকর না-হয় কঠিন পরিস্থিতির চাপে পড়ে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী এনে বাক্স্বাধীনতা খর্ব করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু পরে যখন অবস্থা স্বাভাবিক হল, ভারতের সুস্থিতি নিশ্চিত হল এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম হল, তখন কেন সেই সংশোধনী প্রত্যাহার করা হল না? ইতিমধ্যে তো কংগ্রেসের এক প্রধানমন্ত্রী জরুরি অবস্থা জারি করলেন, আর এক জন দ্য সেটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ করলেন, আরও এক জনের আমলে আমাদের দেশের এক প্রথম শ্রেণির শিল্পী দেশ ছাড়তে এবং বিদেশের মাটিতে বিদায় নিতে বাধ্য হলেন।
বাক্স্বাধীনতা রক্ষায় বিজেপি বা আরএসএস বিরাট উদ্যোগ নেবে, এমনটা বোধহয় প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস আগে যে সব অন্যায় করেছে তা বর্তমান শাসকদের নিজেদের অন্যায়ের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। তবে এটাও বোধহয় বলা চলে যে, এখন দুটো দিক থেকে অবস্থার অবনতি হয়েছে। এক, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মতো বিদ্যা-বিরোধী (অ্যান্টি-ইন্টেলেকচুয়াল) সরকার ভারতে আগে দেখা যায়নি। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টরিকাল রিসার্চ, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া বা সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন-এর মতো প্রতিষ্ঠানের মাথায় যাঁদের বসানো হয়েছে, তাঁদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, বর্তমান শাসকরা পাণ্ডিত্য বা শিল্পসাহিত্যকে কানাকড়িও দাম দেন না। এই মানসিকতা সর্বোচ্চ স্তরেও প্রকট। প্রধানমন্ত্রীও মনে করেন না বিদ্বজ্জন, লেখক, শিল্পীদের সমাজে বড় কোনও অবদান আছে। স্বাধীন চিন্তা ও চিন্তাজীবীদের প্রতি এই অবজ্ঞা নীচের স্তর অবধি সঞ্চারিত হয়।
দ্বিতীয়ত, আগে কিছু লেখকের বই পোড়ানো হয়েছে, কিছু চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড আটকেছে, কিছু শিল্পীর কাজ নষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু এখন, স্বাধীন ভারতে সম্ভবত এই প্রথম, চিন্তাশীল, সম্মানিত লেখকরা তাঁদের স্বাধীন চিন্তার অপরাধে খুন হচ্ছেন, তাঁদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত কয়েক বছরে এমন তিন জনের হত্যাকাণ্ড আমরা দেখেছি: মহারাষ্ট্রে নরেন্দ্র দাভোলকর ও গোবিন্দ পানসারে এবং কর্নাটকে এম এম কালবুর্গি। এটা হয়তো নিছক আপতন নয় যে, তিন জনই নিজের নিজের মাতৃভাষায় লিখতেন। এ কথা বলে হয়তো আমি ভাগ্যের সঙ্গে ঝুঁকির খেলা খেলছি, কিন্তু আমার মতে, ইংরেজি ভাষায় লিখে যে ভারতীয় লেখকরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁরা এ দেশে তুলনায় নিরাপদ। তাঁদের আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং সংবাদমাধ্যমে তাঁদের প্রবল পরিচিতি হয়তো তাঁদের এক ধরনের রক্ষাকবচ দেয়। কিংবা তাঁদের কথা কেবল একটি সীমিত এলিট সমাজের লোক জানে বলে হয়তো জঙ্গি বা মৌলবাদীরা তাঁদের ততটা বিপজ্জনক বলে মনে করে না।
যে তিনটি হত্যাকাণ্ডের কথা বললাম, তাদের প্রত্যেকটির রাজনৈতিক প্রেক্ষিত ছিল স্বতন্ত্র। দাভোলকর হত্যার সময় মহারাষ্ট্রে এবং কেন্দ্রে, দু’জায়গাতেই ছিল কংগ্রেস সরকার। পানসারে যখন খুন হন, তখন দুই সরকারই বিজেপির। কালবুর্গির ক্ষেত্রে কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল বিজেপি, কর্নাটকে কংগ্রেস। কিন্তু তিনটি ঘটনার মধ্যেই একটা হাড়-হিম-করে-দেওয়া সাদৃশ্য লক্ষণীয়। তিন জনই খুন হয়েছেন তাঁদের নিরীশ্বরবাদী ও যুক্তিনির্ভর মানসিকতা এবং হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাঁদের সমালোচনাত্মক ও সংশয়ী ধারণার জন্য। প্রায় নিঃসংশয় ভাবে বলা যায়, তিন জনকেই খুন করেছে হিন্দু মৌলবাদীরা। তার একটা অর্থ, এ ক্ষেত্রে ভারত প্রতিবেশী বাংলাদেশের এক করুণ ও ভয়ানক প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে— সে দেশে যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, নিরীশ্বরবাদী বহু মানুষকে একের পর এক মারা হয়েছে।
আমার নিজের শহর বেঙ্গালুরুতে কন্নড় লেখক ইউ আর অনন্তমূর্তিকে জীবনের শেষ বছরগুলো পুলিশ প্রহরায় কাটাতে হয়েছে। তিনি হিন্দু মৌলবাদের সমালোচনা করায় হিন্দুত্ববাদী গুন্ডারা তাঁকে খুনের হুমকি দিয়েছিল। শেষ অবধি তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে, কিন্তু রাজ্যের কিছু জায়গায় হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা উন্মাদ কুরুচির পরিচয় দিয়ে তাঁর মৃত্যু ‘উদ্যাপন’ করে।
এক দশক আগে আমি ভারতকে ফিফটি-ফিফটি গণতন্ত্র বলেছিলাম, এখনও কি তা-ই বলতে পারি? সমাজ বা জাতি প্রায় কখনওই সরলরেখায় চলে না। কিছু বিষয়ে এগোয়, অন্য কিছু বিষয়ে হয়তো পিছিয়ে যায়। দশ-বিশ বছর আগের তুলনায় তরুণ ভারতবাসীদের (বিশেষত শহরে) নিজের পেশা বা জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে স্বাধীনতা নিশ্চয়ই বেড়েছে। আবার, জাতপাত বা স্ত্রী-পুরুষ বৈষম্য এখনও বিলক্ষণ চালু বটে, কিন্তু জাতিভেদ বা পিতৃতন্ত্রের আদর্শগত প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক কমেছে। অন্য দিকে, জরুরি অবস্থার দিনগুলোকে বাদ দিলে সম্ভবত অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকাররা এখন কম স্বাধীন, তাঁদের বিপন্নতা বেড়ে গিয়েছে।
মুম্বইয়ে প্রদত্ত প্রথম বিজয় তেন্ডুলকর স্মারক বক্তৃতার ভিত্তিতে লেখা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy