নদিয়া জেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম ধোড়াদহের সন্তান, স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার স্বর্গীয় নলিনাক্ষ সান্যালের বন্ধু ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নলিনাক্ষের বিবাহে নজরুল আমন্ত্রিত ছিলেন তাঁর গ্রামের জমিদারবাড়িতে। দুর্ভাগ্য, নলিনাক্ষের অজান্তে নজরুলকে অনুষ্ঠান বাড়িতে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। পরের ঘটনা ইতিহাস। নজরুলের কলম গর্জে ওঠে — ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া...’।
বড় আক্ষেপের বিষয়, দেশের স্বাধীনতার ৭৩তম বর্ষেও আমরা জাত-ধর্ম-বর্ণভিত্তিক অস্পৃশ্যতার বেড়াজাল কেটে বেরিয়ে আসতে পারলাম না। যে বৈষম্যের পাতায় নবতম সংযোজন জোম্যাটো-কাণ্ড।
মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর থেকে বিতর্ক শুরু। মাস গড়ায়নি। তার আঁচ এসে পড়েছে এ রাজ্যেও। জুলাইয়ের শেষে বাড়িতে খাবার ডেলিভারি করার সংস্থা জোম্যাটো জানিয়েছিল, খাবারের কোনও ধর্ম হয় না। সেই ঘোষণাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে ‘খাবার’ আবার পড়ে গেল সাম্প্রদায়িকতার ঘূর্ণিপাকে। গরু-শুয়োরের মাংস পৌঁছে দিতে রাজি নন হাওড়ার কিছু জোম্যাটো কর্মী। ইদের দিনেও তাই হাওড়ার কিছু এলাকায় বন্ধ থাকল জোম্যাটোর ফুড ডেলিভারি সিস্টেম। হাওয়ায় ভাসছে, হাওড়ার ঘটনা উসকে দিয়েছে সিপাহি বিদ্রোহের কার্তুজ-কাণ্ড।
মধ্যপ্রদেশের জবলপুরের পণ্ডিত অমিত শুক্ল অ-হিন্দু ডেলিভারি বয় ফৈয়াজ খাবার আনছেন দেখে অনলাইন খাবার সরবরাহ সংস্থা জোম্যাটোর অর্ডার বাতিল করার পরে মোবাইলের স্ক্রিনশট টুইটার ওয়ালে দিয়েছিলেন। জোম্যাটোর কর্মীদের সঙ্গে ‘চ্যাট’-এর যে স্ক্রিনশট টুইটারে দিয়েছেন অমিত, তাতে এক জায়গায় নিজের আচরণের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। লিখেছেন, ‘‘পবিত্র শ্রাবণ মাস চলছে। তাই কোনও মুসলমানের হাত থেকে খাবার নিতে পারব না।’’ এর পরেই জোম্যাটো তাঁকে মোক্ষম জবাব দেয়, ‘‘খাবারের কোনও ধর্ম নেই। খাবারই ধর্ম।’’
অমিতের যুক্তি ছিল, ‘‘আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মাচরণ কি ভারতের মূলগত ভাবনার মধ্যে পড়ে না? এ আমার ব্যক্তিগত পছন্দের জায়গা।’’ আর ডেলিভারি বয় ফৈয়াজ বলেছেন, ‘‘এই ঘটনায় আমি আহত। কিন্তু কী করব.... আমরা গরিব মানুষ। আমাদের এই রকম ঘটনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়।’’
গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে এই বিতর্ক। গোঁড়ামি ও ঘৃণাকে প্রত্যাখ্যান করে এমন পদক্ষেপ করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় জোম্যাটোর ভূমিকা প্রাথমিক অবস্থায় প্রশংসিত হয়। কটাক্ষ, ব্যঙ্গ, শাণিত মন্তব্যে ‘ট্রোলড’ হন অমিত। কিন্তু পরে সেই নেটিজনরাই বিভাজিত হয়ে যান। তাঁদের একাংশ জোম্যাটোর ভূমিকায় অসন্তুষ্ট। তাঁদের প্রশ্ন, কেন জোম্যাটো অ্যাপে যে সমস্ত রেস্তোরাঁয় ‘হালাল’ মাংস পাওয়া যায়, সেগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে? খাবারের জাতধর্ম না থাকলে এমনটা হল কেন? ধর্ম নিয়ে দু’রকম অবস্থান নেওয়ায় অনেকে অ্যাপ ‘আন-ইনস্টল’ও করে দেন।
উত্তরে জোম্যাটো বলেছে, ‘‘আমরা সব ধর্মকে সম্মান করি। সেই কারণেই খাবার সম্পর্কে সব তথ্য দিই। যেমন জৈন ফুড, ভেগান ফুড, নভরাত্রা থালি ইত্যাদি। যাতে আপনারা পছন্দ মতো খাবার বেছে নিতে পারেন। হালাল ট্যাগও সেই সব রেস্তোরাঁকেই দেওয়া হয় যারা সেই তকমা চেয়ে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই। যাতে আপনি রেস্তোরাঁ সম্পর্কে সমস্তটা জেনে তবেই খাবার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’’
কেউ বলতেই পারেন, তিনি ভেজ ছাড়া খাবেন না। ‘ঝটকা’ মাংস ছাড়া খাবেন না বা হালাল মাংস খাবেন। সেগুলো নিজের নিজের ব্যাক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের রুচির ব্যাপার, খাদ্য সংস্কৃতির ব্যাপার। তাতে অন্যের নাক গলানো ঠিক হবে না। এটা হচ্ছে ‘চয়েস অফ ফুড’। যা খেতে পছন্দ করেন, সেটা খেতে পাওয়ার অধিকার সকলের থাকা উচিত। যে কোনও সভ্য দেশে তা-ই হয়। অপছন্দের খাবার কাউকে খেতে বাধ্য করা অমানবিক। কিন্তু যদি বলা হয়, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা নিচু জাতের ছোঁয়া খাবার নেব না, সেটা ‘চয়েস অফ ফুড’ নয়, সেটা সরাসরি ‘রেসিজ়ম’।
কোনও দেশের সামাজিক কাঠামোয় এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের সম্পর্ক দৃঢ় করতে বিরাট ভূমিকা রাখে খাদ্য সংস্কৃতি ও বিশ্বাস। খাদ্যাভ্যাস অনেক সময়ে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়। বৈচিত্র্যময় দেশ ভারতে খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে নানা রকম ধর্মীয় বিধিনিষেধও রয়েছে।
ধর্মের বিষয়টি বস্তুতই সংবেদনশীল। খাবার যে ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তা নিয়েও কোন সংশয় নেই। প্রতি একশো কিলোমিটার অন্তর এ-দেশের মানুষের খাবারের রুচি বদলায়। সম্প্রদায় ভেদেও বদলে যায় খাবারের পছন্দ। ভারতের মতো বহুত্ববাদী দেশে খাবারের ক্ষেত্রেও এই বহুত্বকে রক্ষা করা জরুরি। অনেকের মত, ভারতের খাবারের এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে সুরক্ষিত রাখাও কর্পোরেট সংস্থাগুলির দায়িত্ব হওয়া উচিত।
ভারতীয় সভ্যতা প্রায় আট হাজার বছরের পুরনো। তার আড়াই হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস রয়েছে।
কিছু ঐতিহাসিক একে ‘বিশ্বের প্রাচীনতম জীবন্ত সভ্যতা’ বলেও মনে করেন। ভারতের মতো সুমহান ঐতিহ্যশালী বহুত্ববাদী দেশে ছুঁৎমার্গ কাম্য নয়।
যে দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ডানায় ভর করে চাঁদের মাটিতে পা রাখতে চলেছে, সেই দেশে ডেলিভারি বয় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বলে তাঁর কাছ থেকে খাবার নেওয়া হবে না বা গৃহস্থ বাড়িতে ভিন্নধর্মীয় বা নিম্ন সম্প্রদায়ের দিনমজুরের খাবারের পাত্রটি উঠোনের নির্দিষ্ট জায়গায় অচ্ছুৎ অবস্থানে রেখে দেওয়া হবে বা মিড-ডে মিলের সময়ে তথাকথিত নিম্নবর্গের সঙ্গে উচ্চবর্গের ছেলেমেয়েরা এক পঙ্ক্তিতে বসে খেতে অস্বীকার করবে— এই ধরনের গোঁড়ামি ও কুসংস্কার শুধু দুর্ভাগ্যজনক তা-ই নয়, তা বৃহদর্থে ভারতীয়ত্বের মূল ধারণাটির সঙ্গেও যায় না।
শিক্ষক, শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy