রবিবার সন্ধ্যায় হংকং শহরের ইউয়েন লং অঞ্চলের একটি মাস ট্রানজ়িট স্টেশনে অকস্মাৎ তাণ্ডব চালায় কতিপয় মুখোশধারী ব্যক্তি। যাত্রীদের প্রহার করে। মুখোশের আড়ালে কাহারা ছিল, সেই ব্যাপারে অনুমানই ভরসা, তবে আক্রান্তদের অধিকাংশই যে হেতু একটি সরকার বিরোধী জমায়েত হইতে ফিরিতেছিলেন, অতএব অনুমান শক্ত নহে। আক্রান্ত আইনসভার সদস্য লাম চেউক-তিংয়ের কণ্ঠে সেই সন্দেহ ধ্বনিত হইয়াছে— ‘হংকং কি এখন ট্রায়াডদের মুক্তাঞ্চল হইল?’ সপ্তদশ শতকে চিনে প্রতিষ্ঠিত সংগঠিত দুষ্কৃতী সিন্ডিকেটগুলিকে বলা হইত ট্রায়াড। অভিযোগের অভিমুখ চিনের দিকেই— প্রতিবাদী নাগরিকদের ভয় দেখাইতে চিন বেসরকারি বাহুবল ব্যবহার করিতেছে। প্রশ্ন আরও আছে। নাগরিক-পুলিশ অনুপাতে বিশ্বের অন্যতম সেরা রাষ্ট্র হংকংয়ে আক্রান্ত যাত্রিসাধারণকে বাঁচাইতে কোনও আইনরক্ষকের দেখা মিলিল না কেন? ভিডিয়ো ফুটেজে এক তরফা হিংসা দেখিবার পরেও কেন দুই পক্ষেরই নিন্দা করিলেন হংকং প্রশাসক ক্যারি ল্যাম? বৈদেশিক শক্তির প্রতি আনুগত্য থাকিতে পারে, আন্দোলনের দাবি লইয়া আপন নাগরিকদের সহিত সংঘাতও হইতে পারে, কিন্তু অহিংস নাগরিকের উপর বাহুবলীদের আক্রমণেও কি দেশের প্রশাসক ‘নিরপেক্ষ’ থাকিতে পারেন? চিন ঘনিষ্ঠ শাসকের অদ্ভুত নীরবতা অনেক কিছুই বলিয়া দিতেছে।
কিন্তু, মূল প্রশ্ন অন্যত্র। হংকংয়ে না হইয়া চিনের মূল ভূখণ্ডে যদি নাগরিকদের এমন বিক্ষোভ দমন করিতে হইত, তাহা হইলেও কি রাষ্ট্রযন্ত্রকে এ হেন চোরাগোপ্তা আক্রমণের পথেই হাঁটিতে হইত? ১৯৮৯ সালের স্মৃতি এই প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তর দিবে। চিনের বহু কারাগারে বহু বন্দির কণ্ঠস্বর যদি বাহিরে শোনা যাইত, তবে তাঁহাদের উত্তরও নেতিবাচক হইত। সর্বাধিপত্যকামী রাষ্ট্র নাগরিকের প্রতিবাদ দমন করিতে প্রত্যক্ষ আক্রমণের পথেই হাঁটিতে অভ্যস্ত। এইখানেই হংকংয়ের সহিত চিনের মূল ভূখণ্ডের ফারাক। প্রকৃত গণতন্ত্র যদি না-ও বা থাকে, তবু খাতায় কলমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সহিত সর্বাধিপত্যকামী শাসনের ফারাক অলঙ্ঘ্য। রাষ্ট্রযন্ত্র যতই নারাজ হউক, তবুও নাগরিকের প্রতিবাদ জানাইবার পরিসরটিকে সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করিয়া দেওয়া রাষ্ট্রের অসাধ্য। গণতন্ত্র নামক ধারণাটির জন্যই। ঠিক সেই কারণে এই পরিসরটিকে রক্ষা করিতে নাগরিকের সচেতনতার গুরুত্ব অসীম। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই বিরোধিতার পরিসরটিকে নষ্ট করিতে শাসককে অজুহাত খাড়া করিতে হয়। কখনও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে, কখনও জাতীয়তাবাদের নামে, কখনও দেশদ্রোহী শক্তির প্রতি নাগরিকের সহানুভূতি ভাঙিবার নামে শাসক এই পরিসরটিকে খর্ব করিতে চাহেন, ধ্বংস করিতে চাহেন। এই যুক্তিগুলি সম্বন্ধে অতএব সতর্ক থাকা বিধেয়। দেশপ্রেমের আবেগে গা ভাসাইয়া শাসকের অভিসন্ধি বিষয়ে অসতর্ক হইলে বিপদ— বিরোধিতার পরিসরটি যত সঙ্কুচিত হইতে থাকে, তাহার সঙ্কোচনের বেগও ততই বাড়ে। রাষ্ট্রের প্রতি প্রশ্নহীন বিশ্বাস পোষণ করা নাগরিক এক সময় দেখিতে পান, মানিয়া লওয়া ভিন্ন আর কিছু করিবার উপায় নাই। অবশিষ্ট বিশ্বও আর জানিতে পারে না, লৌহ যবনিকার ভিতর কোন দমনপীড়ন চলিতেছে। বিরোধিতার পরিসরটুকু বাঁচাইয়া রাখাই নাগরিক সমাজের বৃহত্তম সংগ্রাম। হংকংয়ে যেমন, ভারতেও তেমনই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy