দশ বৎসর অতিক্রান্ত। স্টিফেন কোর্টকে কি কেহ মনে রাখিয়াছে? একদা অগ্নিদগ্ধ বাড়িটির সম্মুখে জ্বলা মোমবাতির সংখ্যা বিচার করিলে এই প্রশ্ন মনে জাগিতে বাধ্য। এক-এক করিয়া বৎসর অতিবাহিত হইয়াছে, মোমবাতির সংখ্যাও কমিয়াছে। দশ বৎসর পূর্বে এই মার্চ মাসেই পার্ক স্ট্রিটের অভিজাত বাড়িটির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড প্রাণ লইয়াছিল যে তেতাল্লিশ জনের, তাঁহাদের স্বজনদেরও বিশেষ দেখা মিলে না নির্দিষ্ট দিনটিতে। তবে তাহার অর্থ ইহা নহে যে, স্টিফেন কোর্ট কলিকাতাবাসীর স্মৃতি হইতে মুছিয়া গিয়াছে। ২০১০ সালের পর হইতে শহরে যতগুলি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়াছে, প্রত্যেকটির আলোচনায় এক বার করিয়া উঠিয়া আসিয়াছে স্টিফেন হাউসের নাম। দ্বিপ্রহরে দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে থাকা অভিজাত বাড়িটির দৃশ্য, কিংবা প্রাণ বাঁচাইবার মরিয়া প্রচেষ্টায় উপর হইতে ঝাঁপ দিবার দৃশ্য সহজে ভুলিবার নহে।
কিন্তু মনে রাখিলেও সেই অগ্নিকাণ্ড হইতে কলিকাতা কি কিছু শিক্ষা লইয়াছে? না, লয় নাই। পার্ক স্ট্রিটে দমকল বিভাগের অভিযানে দেখা গিয়াছিল, এক বিখ্যাত বহুজাতিক সংস্থা তাহাদের রেস্তরাঁ চালাইতেছে দমকল বিভাগের প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র ছাড়াই। ওই একই অভিযানে ধরা পড়িয়াছিল শুধু পার্ক স্ট্রিট চত্বরেই একাধিক রেস্তরাঁ চলিতেছে অগ্নিসুরক্ষার ন্যূনতম বিধিগুলি না-মানিয়াই। কোথাও আপৎকালীন নির্গমনের রাস্তাটি অত্যন্ত অপরিসর, কোথাও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাটিই অকেজো। সত্যই যদি কখনও সেখানে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, ফল কী হইবে, সহজে অনুমেয়। শুধুমাত্র রেস্তরাঁ নহে, শহরের বৃহৎ বাজার হইতে বহুতল, এমনকি হাসপাতালের চিত্রটিও একই। বিগত দশ বৎসরে শহর কম অগ্নিকাণ্ড দেখে নাই। তাহার মধ্যে ঢাকুরিয়ার হাসপাতাল হইতে বড়বাজার এবং গড়িয়াহাটের মোড়— সবই আছে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের প্রাথমিক উত্তেজনা, ক্ষয়ক্ষতির বিষাদ স্তিমিত হইবার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই পূর্বের অব্যবস্থা পুনরায় ফিরিয়া আসিয়াছে। গড়িয়াহাট ফুটপাতের অস্থায়ী বাজারের উপর হইতে প্লাস্টিকের ছাউনিও সরে নাই, বড়বাজারের অপরিসর রাস্তার দুই ধারের দাহ্য পদার্থের বিক্রিও সম্পূর্ণ বন্ধ হয় নাই।
এবং পুলিশ-প্রশাসনের নির্বিকার ভাবও কাটে নাই। প্রত্যেক অগ্নিকাণ্ডের পরই জানা যায়, কী ভয়াবহ বিপদ মাথায় লইয়া এত কাল দিব্য ব্যবসা ফাঁদিয়া বসিয়াছিলেন মালিকেরা। অথচ, প্রশাসন তাহাতে বাধা দেয় নাই। খাস রাজধানীর জনবহুল স্থানগুলিতে এ-হেন বিপদ সম্ভাবনার কথা প্রশাসনের নজরে এড়াইয়া গিয়াছে বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে। দুর্নীতির দীর্ঘ ছায়া নজর ঘুরাইতে সদাই প্রস্তুত। সেই কারণেই দমকলের ছাড়পত্র ছাড়াই বহুজাতিক রেস্তরাঁ শহরের ব্যস্ততম অঞ্চলে নির্বিঘ্নে সাত বৎসর ব্যবসা চালাইয়া যায়। বস্তুত, লোভ এবং দুর্নীতি শহরের বিশেষ বিশেষ স্থানগুলিকে কার্যত জতুগৃহে পরিণত করিয়াছে। বড় মাপের অগ্নিকাণ্ড রুখিতে নিয়মিত ব্যবধানে কঠোর নজরদারি চালাইবার প্রথাটি এখন প্রহসনে পরিণত। প্রশাসনিক কর্তাদের পদধূলি পড়িবার ঠিক আগে তাহাতে কিছু রূপটান দেওয়া হয়, কর্তারা বিদায় লইবার পরমুহূর্তেই ভিতরের কঙ্কালটি বাহির হইয়া পড়ে। এই দুর্নীতির বাসাটি ভাঙা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। অন্যথায়, শোকজ্ঞাপন করিবার জন্য মোমবাতিও কম পড়িবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy