বিষ্ণুপুরের চুয়াশোলের জঙ্গলে আগুন। ফাইল চিত্র
শীত এসে পড়েছে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া-বাঁকুড়া জেলার বিস্তীর্ণ শাল বনের গাছের পাতাও হলুদ হতে শুরু করেছে। ভারতের প্রায় ১৪ শতাংশ বনভূমির মূল উদ্ভিদ এই শাল গাছ। প্রায় সারা বছরই এই গাছের পাতা সবুজ থাকে। শীতকাল এলে সেই যে গাছের পাতা হলুদ হতে শুরু করে, তারপর শীতের শেষে পুরোনো পাতা ঝরিয়ে দুই-তিন মাসের জন্য নেড়া হয়ে যায় ওরা। দাঁড়িয়ে থাকে নতুন পাতা, ফুল-ফল আসার অপেক্ষায়।
এর পর বনভাগ মায়াবী রঙে রাঙিয়ে জন্ম নেয় নতুন পাতা। নেড়া হওয়ার পর শাল গাছের নতুন পাতার রং যাঁরা দেখেননি, তাঁদের কাছে এ এক অবাক করা অনুভূতি। নতুনের পাশাপাশি ঝরে পড়া পুরনো শালপাতা জমা হয় গাছের পাদদেশে। এই ঝেড়ে ফেলে দেওয়া হলুদ শুকনো পাতা ‘বারুদের’ মতো বনভূমির চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক লক্ষ হেক্টর বনভূমির ইতিউতি জমা হতে থাকে শালপাতার ‘বারুদের’ স্তূপ। প্রাকৃতিক নিয়মেই এই ডাঁই হয়ে থাকা শালপাতা ধীরে-ধীরে বনভূমিতে তৈরি করে জৈব সার। উর্বর করে বনের মাটি, খাদ্যের জোগান দেয় গাছপালাদের আর বড়, সুন্দর-সাবলীল হতে সাহায্য করে। নানান বীজ, নানান চারা এই পুষ্ট মাটির রস নিয়ে বনভূমিকে করে তোলে আরও ঘন, আরও সুন্দর।
আমাদের এই শাল গাছ বর্ষায় বনভূমির ক্ষয়রোধ করে। এ ছাড়া জলকে মাটির নীচে নিয়ে গিয়ে মাটির নীচের জলতলকে বাড়াতে, নানান উপকারী প্রাণীদের বংশবিস্তার-সহ তাদের বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি করতে এই শালপাতারা বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। মাটির উপর শালপাতার পুরু আচ্ছাদন মাটির উপর বর্ম স্বরূপ। যা বনের পরিবেশকে নষ্টের হাত থেকে রক্ষা করে। বনভূমির মাটি উর্বর করার এটাই একমাত্র প্রাকৃতিক উপায়। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের এত বিশাল বনভূমির মাটিকে উর্বর করা ও তাকে ধরে রাখার আর কোনও সহজ উপায় আমাদের কাছে নেই। এই প্রাকৃতিক নিয়মের উপর ভর করেই সমৃদ্ধ হয় গোটা শাল বনের বন্যপ্রাণ তথা বন্যপ্রাণীর জীবনচক্র।
শীতের শেষে শুকনো আবহাওয়ায় প্রায়ই ভারতের কোথাও না কোথাও জমা শাল পাতার স্তূপে আগুন ধরে। প্রতি বছরই দেখা যায় কয়েক লক্ষ হেক্টর বনভূমি সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। বাঁকুড়া-পুরুলিয়া জেলার বনভূমিও তার ব্যতিক্রম নয়। আগুনের লেলিহান শিখা প্রথমে শুকনো শালপাতার সাহায্য নিয়ে ধীরে-ধীরে বনভূমির নীচে আধা শুকনো গাছ, গুঁড়ি, পড়ে থাকা কাঠ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে ক্রমে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। তার পর তার সাম্রাজ্য বিস্তারে নানান সবুজ লতা-পাতা, ছোট-ছোট নানান প্রজাতির গাছ, গাছের চারা, বর্ষায় সময় গজিয়ে ওঠার অপেক্ষায় আগামী নতুন উদ্ভিদের কন্দ, বীজ ও মূল, মাটির নানান উপকারী জৈব-অজৈব পর্দাথ, প্রাণীদের জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে এগিয়ে যায় আরও সামনে। ছড়িয়ে পড়ে বনভূমির অন্য প্রান্তে। প্রথমেই এ আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরে এর ভয়ঙ্কর শক্তি বাগে আনা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যদি বাতাসের গতিবেগ ভাল থাকে। যেমনটি হয়েছিল কয়েকমাস আগে ব্রাজিলে আমাজনের বনে। কিংবা এখন যেমন চলছে অষ্ট্রেলিয়ায়।
এই লেলিহান আগুনে বন্যপ্রাণীরা ভয় পেয়ে দিক্ভ্রান্ত হয়ে ছুটতে থাকে। হারিয়ে যায় ওদের বাসস্থান, মারা পড়ে ওদের ছোট বাচ্চারা। এমনকি, বড় প্রাণীরা অনেকেই হয় আংশিক ভাবে মারাত্মক ঝলসে যায়, না হয় একেবারেই মারা পড়ে। আতঙ্কের রেশেই অনেক প্রাণীর বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হয়। গাছে বাসা করে থাকা পাখিরা আগুনের হাত থেকে বাঁচতে যে দিকে পারে পালাতে থাকে। যারা পারে না তারা মারা পড়ে। মাটির উপরিভাগ পুড়ে পাথরের মতো নিস্প্রাণ, ভঙ্গুর এবং জৈব-অজৈব পর্দাথবিহীন এক পর্দাথের রুপ ধারণ করে। বড়-বড় শাল গাছের কান্ডের উপর তার একমাত্র সংবহনপ্রণালি তন্ত্রের পুরু ছাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে তার শারীরবৃত্তীয় কাজ ব্যাহত হয়। ব্যাহত হয় তার বৃদ্ধি, পরিপাকপ্রণালী এবং বংশবৃদ্ধির নানান প্রয়াস। বেশ কিছু গাছ মারা পড়ে। মাটির উপর ছড়িয়ে মাটিকে আকড়ে থাকা শিকড়ের জাল পুড়ে ছিন্ন হয়ে যায়। আলগা হয় মাটি, পরবর্তী বর্ষায় প্রবল ভূমিক্ষয় দেখা দেয়। দেখা দেয় বৃষ্টির জল ধরে রাখার অক্ষমতা। সব মিলে অপূরণীয় ক্ষতি হয় পরিবেশের।
প্রাকৃতিক দাবানল রোখার বিষয়ে আমাদের করণীয় কিছু নেই। তা প্রাকৃতিক নিয়মেই হবে, যদি হওয়ার থাকে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, বনে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা ইচ্ছাকৃত ভাবে সংঘঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। কিছু মানুষ বন্যপ্রাণী শিকারের উদ্দেশ্যে বা আগুনে পুড়ে যাওয়া শুকনো কাঠ-জ্বালানি সংগ্রহ করার জন্য বা বনের জমি দখলের কারণে বা গবাদি পশুর চারণভূমির জন্য বা মজার জন্য আগুন লাগায়।
আগুনের ফলে সৃষ্ট কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনো-অক্সাইড সহ পরিবেশের ক্ষতিকারক নানান গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে বনের চারিদিকে। যার পরিমাণ কয়েক লক্ষ গাড়ির ধোঁয়ার সমান। সব মিলে বনে লেগে যাওয়া আগুনে ক্ষতি পরিমাণ মাপলে চমকে উঠতে হবে। শুধু বন দফতর একাজ রুখতে পারবে না। তাদের শুধু কাঠগোড়ায় তুললে ভুল হবে। বনে আগুন বন্ধ করতে হলে চাই সচেতনতা আর সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। তবে বন দফতরকেই বনে আগুন বন্ধে কাণ্ডারীর ভূমিকার দায়িত্ব নিতে হবে।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত বন আধিকারিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy