Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

‘নাগালিম’ একটি অধরা স্বপ্ন

৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৩ সাল। নাগাল্যান্ড গঠন হল। কিন্তু নাগা বিদ্রোহীরা এই নিষ্পত্তি মেনে নিল না। ‘নাগালিম’-এর দাবি থেকে তারা পিছু হটল না। লিখছেন গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৩ সাল। নাগাল্যান্ড গঠন হল। কিন্তু নাগা বিদ্রোহীরা এই নিষ্পত্তি মেনে নিল না। ‘নাগালিম’-এর দাবি থেকে তারা পিছু হটল না। এ দিকে ভারতের পক্ষে ‘নাগালিম’ এবং তাঁর আনুষঙ্গীক দাবিগুলি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, দাবিগুলির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে

মুইভা (বাঁ দিকে) এবং সু (ডান দিকে)। ফাইল ছবি

মুইভা (বাঁ দিকে) এবং সু (ডান দিকে)। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৩৬
Share: Save:

‘নাগালিম’ এখন একটি বহুল প্রচলিত শব্দ । যার অর্থ হল বৃহত্তর নাগাল্যান্ড। শব্দটির উৎপত্তি ১৯৫০ সালে। এর পিছনে আছে রক্তক্ষয়ী ইতিহাস।

৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৩ সাল। নাগাল্যান্ড গঠন হল। কিন্তু নাগা বিদ্রোহীরা এই নিষ্পত্তি মেনে নিল না। ‘নাগালিম’-এর দাবি থেকে তারা পিছু হটল না। এ দিকে ভারতের পক্ষে ‘নাগালিম’ এবং তাঁর আনুষঙ্গীক দাবিগুলি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, দাবিগুলির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে

বিদ্রোহীদের দাবি ছিল, মণিপুর, অসম এবং অরুণাচল প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে নাগারা বাস করেন সেই জেলাগুলি মূল নাগাল্যান্ডের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বৃহত্তর নাগাল্যান্ড গঠন। এর মধ্যে আছে অসমের ২৪,৩৪৩ বর্গকিলোমিটারে (কারবি আলং ১০,৪৩৪ বর্গকিলোমিটার, নর্থ কাছাড় হিলস ৪,৮৮৮ বর্গকিলোমিটার, গোয়ালঘাট ৩,৫০২ বর্গকিলোমিটার, শিবসাগর ২,৬৬৮ বর্গকিলোমিটার এবং জোড়হাট ২,৮৫১ বর্গ কিলোমিটার ), মণিপুরের ১৫,৫১৯ বর্গকিলোমিটার (চানডেল ৩,৩১৩ বর্গকিলোমিটার, উখরুল ৪৫৪৪ বর্গকিলোমিটার, সেনাপতি ৩,২৭১ বর্গকিলোমিটার এবং তামেলাং ৪,৩৯১ বর্গকিলোমিটার) এবং অরুণাচল প্রদেশের ৭,০২৪ বর্গ কিলোমিটার (তিরাপ ২,৩৬২ বর্গকিলোমিটার এবং চাংলাং ৪,৬৬২ বর্গকিলোমিটার) অর্থাৎ মোট প্রায় ৪৬,৮৮৬ বর্গকিলোমিটার বর্তমান নাগাল্যান্ডের (১৬,৫৮৯ বর্গকিলোমিটার) সঙ্গে জুড়তে হবে। মনে রাখতে হবে, এই জেলাগুলিতে শুধু নাগারা থাকেন না, অন্য উপজাতির লোকও বাস করে। যেমন, মণিপুরে উখরুল (তাংখাউল), সেনাপতিতে (মাও, পোমাই, মারম) তামেংলং এ (জলিরাস)এবং অরুণাচলের তিরাপ এবং চাংলং জেলায় প্রচুর ‘কনইয়াক’ সম্প্রদায়ের লোকেদের বাস। এই সব উপজাতিগুলির ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, অনুষ্ঠান নাগাদের থেকে আলাদা।

এখানে উল্লেখ্য, যেখানে খোদ নাগাল্যান্ডে মাত্র ১,০০০ জন তাংখাউল নাগারা বাস করেন, সেখানে মণিপুরে তাংখাউল নাগার সংখ্যা ১,৩৫,০০০ জন। তাঁরা প্রধানত উখরুল এবং তামেংলং জেলার বাসিন্দা। এরা ‘নো হোয়ার ট্রাইব’ বা কোনও এলাকার নয় বলে পরিচিত। অর্থাৎ এদের কোনও রাজ্যেই স্বীকৃতি নেই। মণিপুরে ‘মেইতেই’রা সংখ্যাগুরু, তাঁরা নাগাদের এই উপজাতিকে মণিপুরী বলে গণ্য করেন না। আবার নাগাল্যান্ডের সব উপজাতিই এদের বহিরাগত বলে গণ্য করে।

বিদ্রোহীরা দাবি করেছিল, নাগাল্যান্ডের জন্য আরও স্বায়ত্তশাসনের, অনেকটা পূ্র্বতন কাশ্মীরের মতো। যার মধ্যে প্রধান ছিল, নাগাদের সম্পূর্ণ পৃথক পরিচিতি বা নাগা রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক বলে মান্যতা। নাগাল্যান্ডের জন্য পৃথক একটি ‘প্ল্যানিং কমিশন’ গঠন। নাগা রাজ্যের জন্য পৃথক পতাকা। রাজ্য মানব অধিকার কমিশন গঠন। নাগা পতাকা ব্যবহার করে ব্যবসা ও পর্যটন বৃদ্ধির জন্য পৃথক কেন্দ্র খোলা। নাগাল্যান্ডের জন্য শুল্ক আইনের পরিবর্তন করা। নাগা-পরিষদ এবং মন্ত্রীদের নৃতাত্ত্বিক নামকরন। এবং, পৃথক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ সালে ‘ওখা’ তে জয়প্রকাশ নারায়ণ, বিমলপ্রসাদ চালিহা এবং খ্রিস্টান মিশনারি রেভারেন্ড মাইকেল স্কটকে নিয়ে একটি শান্তি কমিটি গঠন করা হয় এবং ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে নাগা বিপ্লবীদের ছ’বার বৈঠক হয়। কিন্তু নাগারা তাদের দাবিতে অনড় থাকে। জয়প্রকাশ নারায়ণ ১৯৬৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে ওই কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। স্কটের ভারত-বিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই আক্রোশে, নাগা সন্ত্রাসবাদীরা লামডিঙ (২০ এপ্রিল, ১৯৬৬) এবং ডিপুতে (২৩ এপ্রিল, ১৯৬৬) ট্রেনে বিস্ফোরণ ঘটায় যাতে ১০০ জনের বেশি মারা যান। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চালিহাও পদত্যাগ করেন। ফলে শান্তি প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়।

আবার শুরু হয় রক্তপাত। নরমপন্থী বিপ্লবী নেতা কাইট সেমা গোপনে দিল্লির সঙ্গে সমঝোতার হাত বাড়ান। ফলে চরমপন্থীরা (ফিজো গ্রুপ), ৩ অগস্ট, ১৯৬৮ সালে কহিমা বাজারে তাঁকে হত্যা করে। ১৯৭২ সালে চরমপন্থীদের হাতে আক্রান্ত হন মুখ্যমন্ত্রী হকিশে সেমা। ভারত সরকার তখন চরম দমননীতি প্রয়োগ করে (নাগাল্যান্ড সিকিউরিটি রেগুলেশন ১৯৬২)। শুধু সেনা তৎপরতা নয়, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং সেবাও বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। কিছু বিদ্রোহী মায়ানমার পালিয়ে যায় আর ফিজো পালায় লন্ডনে। ৩১ জানুয়ারি (মতান্তরে ৩১ মার্চ) ১৯৮০ তে তৈরি হল ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড’। তারা মাও জে দঙ-এর চিন্তাধারা এবং মতবাদ কে ভিত্তি করে এক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার কথা বলে। এর সভাপতি ‘আইজ্যাক চিসি সু’, সহ-সভাপতি ‘এস এস খাপলাং’ এবং সাধারণ সম্পাদক ‘থুইংগালং মুইভা’।

১৯৯০-২০০০ সালে ‘এনএসসিএন’ বন্দুকের ডগায় একটা সমান্তরাল সরকার চালাতে থাকল। সরকারি কর্মচারীদের থেকে ১০, ২০ এবং ৩০ শতাংশ হারে মাসিক শুল্ক ধার্য করা হয়। সরকারের লক্ষ লক্ষ টাকা তাদের ঘরে চলে যেতে থাকে। শিলং-এ বিশাল সম্পত্তি এবং চিন ও আমেরিকা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কেনা হতে থাকল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় অফিস খোলা হল। নাগা সমস্যার একটি আন্তর্জাতিক রূপ দেয়া হল এবং রাতারাতি মুইভা আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে জনতার রোষ টের পেয়ে মুইভার বাহ্যিক রূপান্তর ঘটল। মাওবাদের দর্শন, কার্ল মার্ক্সের সমাজতন্ত্রবাদে দীক্ষিত বিপ্লবী, যিশুর কথা প্রচার করতে থাকল। কিন্তু, ‘নাগালিম’ এর ভাবাদর্শ থেকে এক চুলও নড়ল না। তার মুখে শোনা গেল, ‘উই আর ফাইটিং এগেস্ট ইউ টু প্রিজার্ভ আওয়ার ট্রাইবাল কালচার … খ্রিস্টানিটি’। ২০০৫-’১৮ সাল তাঁদের শ্লোগান হল, ‘নো কম্প্রমাইজ স্ট্যান্ড অন দা ক্রিয়েশন অব এ গ্রেটার নাগাল্যান্ড, ‘হোম ল্যান্ড’। শোনা যাছে, একটি চিরস্থায়ী শান্তি চুক্তি হতে চলেছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইল সারা ভারত।

প্রাক্তন অধ্যক্ষ, বিধানচন্দ্র কলেজ আসানসোল

অন্য বিষয়গুলি:

Nagaland nagalim Socialist Capitalist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy