Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Kabir Suman

গঙ্গাফড়িং নামধারী ইচ্ছে এবং পৃথিবীর মহাফেজখানায় আজব সব ইচ্ছাপত্র

সুমনের এই ‘উইল’ যেন হঠাৎ চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা তুলে নেওয়ার অনুভূতির জন্ম দিল।

সুমনের ইচ্ছাপত্র বা উইল মনে করিয়ে দিয়েছে বিখ্যাত কিছু মানুষের আশ্চর্য উইলের কথা। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

সুমনের ইচ্ছাপত্র বা উইল মনে করিয়ে দিয়েছে বিখ্যাত কিছু মানুষের আশ্চর্য উইলের কথা। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২০ ১৩:৪২
Share: Save:

কবীর সুমন আবার শিরোনামে। এবারের কারণটি একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বহস্তে লিখে বিষয়টি জানানোয় নৈর্ব্যক্তিকও বটে। সুমন সম্প্রতি তাঁর ইচ্ছাপত্র (উইল) নিজে হাতে লিখে পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। যেখানে তিনি তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কাছে থাকা তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেওয়ার আবেদন রেখেছেন।

সুমনের এই ‘উইল’ যেন হঠাৎ চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা তুলে নেওয়ার অনুভূতির জন্ম দিল। যেমন দিয়েছিল ১৯৯৭ সালে শম্ভু মিত্রের প্রয়াণের পরে। তাঁর ইচ্ছানুসারেই তাঁর নশ্বর দেহ গণমাধ্যম এবং সরকারি নজর এড়িয়ে তাঁর পরিজন নিভৃতে সৎকারের ব্যবস্থা করেন। কোনও সরকারি বারোয়ারিতলায় তাঁর দেহটি ফেলে রেখে ফুল, মালা, ধুপ, রোদ আর সেলিব্রিটি-সাধারণের আহা-উহুর নাটকীয়তা থেকে নিজেকে বাঁচাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে ইচ্ছাপত্র তৈরি করে ওই ইচ্ছে ব্যক্ত করে গিয়েছিলেন কিংবদন্তি নট।

খুব নিভৃতে চলে গিয়েছেন কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়। মেধাবী এই কবি নিভৃতির অন্তরালে থেকে গিয়েছেন চিরকাল। প্রয়াণেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। নীরব প্রস্থানটিও তাঁর নিজেরই রচনা কি না, তা অবশ্য জানা যায় না।

আরও পড়ুন: মৃত্যুর পর তাঁর সব সৃষ্টি যেন ধ্বংস করা হয়, ইচ্ছাপত্রে ইচ্ছাপ্রকাশ সুমনের

সুমনের ইচ্ছাপত্র বা উইল মনে করিয়ে দিয়েছে বিখ্যাত কিছু মানুষের আশ্চর্য উইলের কথা।

যেমন যুগান্তকারী টেলিভিশন সিরিজ ‘স্টার ট্রেক’-এর স্রষ্টা জিন রডেনবেরি। মহাকাশপ্রেমী এই মানুষটি শুধুমাত্র সাড়াজাগানো স্পেস অ্যাডভেঞ্চারের জন্ম দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, তাঁকে মহাকাশেই সমাধি দেওয়া হোক। ১৯৯১-এ রডেনবেরি মারা যান। আর ১৯৯২-এ তাঁর দেহাবশেষ ‘কলম্বিয়া’ নামের এক মহাকাশযান মরফত পাঠানো হয় মহাকাশে। কার্যত তিনিই প্রথম মানব, যাঁকে মহাকাশে ‘সমাধি’ দেওয়া হয়েছিল।

সুমন সম্প্রতি তাঁর ইচ্ছাপত্র (উইল) নিজে হাতে লিখে পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। —ফাইল চিত্র।

মার্কিন কমেডিয়ান জ্যাক বেনি মারা যান ১৯৭৪ সালে ৮০ বছর বয়সে। অভিনয় জীবনে যিনি ‘টাইমিং’-এর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। নিজের উইলে তিনি লিখে গিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন প্রত্যহ যেন তাঁকে একটা করে গোলাপ পাঠানো হয়। সেইমতো ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন: ঐতিহ্যের রূপ ধরে সমাজব্যবস্থা মেয়েদের ক্ষতি করে চলেছে

আরও আজব উইল ছিল প্রখ্যাত জাদুকর হ্যারি হুডিনির। যে কোনও বন্ধন থেকে পালিয়ে বেরিয়ে আসার জাদু, যা ‘এস্কেপোলজি’ নামে পরিচিত, হুডিনি ছিলেন তারই গুরুস্থানীয়। জীবনে বেশ কয়েক বার তাঁকে জীবন্ত সমাধি দেওয়া হয় এবং তিনি তা থেকে বেরিয়ে আসেন। ১৯২৬ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যান হুডিনি। পরলোকে ঘোরতর বিশ্বাসী জাদুকর তাঁর উইলে লিখে গিয়েছিলেন, প্রতি বছর তাঁর মৃত্যুদিনে যেন একটি প্ল্যানচেটের ব্যবস্থা রাখা হয়। হুডিনি নাকি তাঁর স্ত্রী-কে ওই ‘বিশেষ’ প্ল্যানচেটের কৌশল শিখিয়েও গিয়েছিলেন। তবে সেই প্ল্যানচেটে তিনি পরলোকের বন্ধন ছিন্ন করে জীবনে হাজির হতে পারতেন কি না, তা জানা যায় না।

এসব ঘটনার কয়েকটির মধ্যে কোথাও নিজেকে ‘অমর’ করে দেখার একটা প্রয়াস রয়েছে। কিন্তু নিজেকে এবং নিজের বিশিষ্টতাকে বিলীন করে দেওয়ার ইচ্ছাও অনেক খ্যাতজন প্রকাশ করে গিয়েছেন।

২০০৭-এ পর্তুগালের এক অভিজাত ও ধনাঢ্য মানুষ লুইস কার্লোস মারা যান। তিনি তাঁর বিপুল সম্পত্তি দান করে যান ৭০ জন অপরিচিত ব্যক্তিকে। তাঁদের তিনি নাকি নিজের ইচ্ছেমতো বেছে নিয়েছিলেন টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে। তুলনায় আরও গোলমেলে উনিশ শতকের জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের উইল। তিনি তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি স্ত্রী মাথিলডেকে দিয়ে যান একটাই শর্তে যে, মাথিলডেকে পুনর্বিবাহ করতে হবে। হাইনের বক্তব্য ছিল, “অন্তত একজন মানুষ আমার মৃত্যু নিয়ে আফশোস করবে!” সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছিলেন মাথিলডের হবু স্বামীর কথা। হাইনের কবিতা একাধারে ছিল তীব্র প্রেম, প্যাশন আর তীক্ষ্ণ শ্লেষের। উইলের শর্তও যেন তাঁর কবিতার মতোই।

প্রেমের কবিতার অনন্য দিশারী, চিরজীবী নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর উইলে যাবতীয় সম্পত্তি দান করে যান কন্যাকে। খালি একটি খাট, যেটিকে তিনি তাঁর ‘দ্বিতীয় প্রিয় শয্যা’ বলে মনে করতেন, সেটি দিয়ে যান তাঁর স্ত্রী-কে।

ফেসবুকে পোস্ট করা কবীর সুমনের ইচ্ছাপত্র।

মানব-চিন্তনের ইতিহাসের অন্যতম যুগপুরুষ ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তাঁর উইলে উল্লেখ করেন, তাঁকে যেন পূর্ণ ক্যাথলিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। আজীবনের ‘কালাপাহাড়’ ফুকো, যিনি বিশ্ব সম্পর্কে মানুষের যাবতীয় ভাবনাকে তিল তিল করে নস্যাৎ করেছিলেন, তিনি কেন এমনটা করেছিলেন? ফুকোর আরও নির্দেশ ছিল, তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর অপ্রকাশিত রচনার একটি অক্ষরও যেন প্রকাশ করা না হয়। কঠোর ভাবে মানা হয়েছিল সেই উইল। ‘হিস্ট্রি অব সেক্সুয়ালিটি’ নামের মহাগ্রন্থের তিনটি খণ্ড তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়। তিনি নাকি পরবর্তী খণ্ডগুলিও লিখেছিলেন। কিন্তু উইলমাফিক সেগুলি অপ্রকাশিতই থেকে যায়।

সুমন কেন এমন ইচ্ছাপত্র রচনা করলেন, তার খানিক ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন শনিবার ফেসবুকে তাঁর দীর্ঘ অডিও লাইভে। যেখানে তিনি তাঁর দিকে ধেয়ে-আসা নানা সময়ে নানা অপমানের কথা বলেছেন। কিন্তু একইসঙ্গে ফেসবুক পোস্টে তিনি এ-ও বলেছিলেন, তিনি মোটেই হতাশ নন।

হতে পারে। ইচ্ছে হল, হাজার হোক, এক ধরনের গঙ্গাফড়িং।

অন্য বিষয়গুলি:

Kabir Suman Will Sombhu Mitra Michel Foucault
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy