Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
তথ্যের অভাবে রোগী মরে?
coronavirus

এই দুঃসময়ে আর একটা কার্ড নয়, আর একটা শয্যা চাই

করোনার দাপটে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর বহর দেখে মানুষ যখন দিশাহারা, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আশ্বাস দিচ্ছেন, চিন্তা নেই, ডিজিটাল কার্ডে রোগীর চিকিৎসার সব তথ্য থাকবে।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:২০
Share: Save:

তেষ্টায় চাইলাম এক ঘটি জল, তাড়াতাড়ি নিয়ে এল আধখানা বেল। ডিজিটাল স্বাস্থ্য কার্ডের ঘোষণায় তেমনই হতবুদ্ধি হতে হয়। করোনার দাপটে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর বহর দেখে মানুষ যখন দিশাহারা, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আশ্বাস দিচ্ছেন, চিন্তা নেই, ডিজিটাল কার্ডে রোগীর চিকিৎসার সব তথ্য থাকবে। যেন তথ্যের অভাবে মানুষ মরছে, হাসপাতালের শয্যার অভাবে নয়! চিকিৎসক, ভেন্টিলেটর, পরিচর্যার অভাব যেন এই মুহূর্তের তীব্রতম সমস্যা নয়। অন্য সময় হলে হয়তো এমন প্রস্তাবকে ‘আইডিয়া হিসেবে মন্দ নয়’ বলে উল্টেপাল্টে আলোচনা করা যেত। কিন্তু এমন আপৎকালে প্রশ্ন করতেই হয়, রোগীর তথ্য বড়, না কি রোগীর প্রাণ?
রোগীর তথ্য চটজলদি হাতে পেলে ডাক্তারের সুবিধে হয় বইকি। কিন্তু ভারতের মানুষ কোথায়, কার কাছে চিকিৎসা করান, তা কি সরকার জানে না? গ্রামের অন্তত ৭৮ শতাংশ মানুষের কার্ডে কখনও লেখা হবে না, তিনি কোন অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছেন, কিসে তাঁর অ্যালার্জি। মাত্র ১২ শতাংশ গ্রামবাসী পাশ-করা ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করান। সেই এমবিবিএস চিকিৎসকদের অর্ধেকই বেসরকারি। যদি ধরা যায়, তাঁরা যত্ন করে রোগীর ডিজিটাল কার্ডে তথ্য ভরে দেবেন (যা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে, কারণ বহু চিকিৎসক জেনেশুনে অদরকারি এবং অতিরিক্ত দামি ওষুধ লেখেন), তা হলেও অধিকাংশ মানুষের তথ্য ডিজিটাল কার্ডে ধরা অসম্ভব। এই কি তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়?
নীতি তৈরি করতে হলে তথ্য চাই বইকি। নাগরিকের চাহিদা জেনে তবে জোগানের ব্যবস্থা করে সরকার। প্রশ্ন একটাই। স্বাস্থ্যের যে সব তথ্য সরকারের কাছে ইতিমধ্যেই রয়েছে, তাকে কতটা কাজে লাগিয়েছে সরকার? সরকারি সমীক্ষাই বলছে, ভারতে গ্রামীণ উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যায় ঘাটতি প্রায় ৩৩ হাজার, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাড়ে ছ’হাজার, ব্লক স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দু’হাজারেরও বেশি। অর্ধেকেরও বেশি সাবসেন্টারে ধাত্রীর (এএনএম) থাকার কোয়ার্টার্স নেই, ২৫ শতাংশে বিদ্যুৎ নেই। আর ব্লক স্তরের হাসপাতালে চিকিৎসকের অভাব দেখলে হতবাক হতে হয়— সরকারি তথ্য (২০১৭-১৮) বলছে, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতি ৮২ শতাংশ। সার্জন, শিশুচিকিৎসক, স্ত্রীরোগ— চার জনের মধ্যে অন্তত তিন জন নেই।
সমীক্ষা যা বলে না, কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের চিকিৎসকরা একান্তে বলেন, তা হল ব্লক হাসপাতাল চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের ব্লক হাসপাতালে যে চিকিৎসকরা কাজ করছেন, তাঁদের অন্তত ৩০ শতাংশের পোস্টিং গ্রামে। এর ফলে গ্রামে সরকারি চিকিৎসার দশা কী, বোঝাই যায়। পশ্চিমবঙ্গে খাতায়-কলমে রয়েছে ৯০৪টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সরকারি হিসেবেই কাজ করছে ৬০৪টি, তার মধ্যে মাত্র ২৩০টি কাজ করে ২৪ ঘণ্টা। কোভিড আবহে যখন সাধারণ আউটডোর পরিষেবার জন্য হন্যে হচ্ছেন মানুষ, তখন এই খামতিগুলো বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে কেন্দ্র থেকে যেটুকু টাকা আসে, এ রাজ্য তা ব্যয় করে প্রধানত ফ্রি ওষুধের জন্য। টান পড়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে ‘হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার’-এ উন্নীত করার কাজে। কেন্দ্র টাকায় কৃপণ, রাজ্য উদ্যোগে।
‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পে দেড় লক্ষ উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মান উন্নয়ন করা হবে, ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। কিন্তু তাতে সংখ্যার ঘাটতি পূরণ করবে কি? কেরল গত চার বছরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান-সহ নানা কর্মীর জন্য ২৭২১টি নতুন পদ তৈরি করেছে, নিয়োগও করেছে। সে রাজ্য তার প্রয়োজন নিজেই যাচাই করে, নিজেই মেটায়। চাহিদা বাড়লে জোগান বাড়বে না কেন? কেরল যে মাত্র ২৮৭-তে আটকে দিয়েছে কোভিড-মৃতের সংখ্যা, তার একটা কারণ তৎপর প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
কেবল পাশ-করা ডাক্তার জোগালেই হবে না, আছে মানের প্রশ্নও। ল্যানসেট-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র (২০১৮) বলে, ভারতে যত মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান প্রতি বছর (৮ লক্ষ ৩৮ হাজার), তার দ্বিগুণ মারা যান খারাপ মানের চিকিৎসার জন্য (১৬ লক্ষ)। সাধারণত এর জন্য দায়ী করা হয় হাতুড়েদের। পাশ-করা ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ালে চিকিৎসার মান বাড়বে, এমনই ভাবা হয়। কিন্তু মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক জিষ্ণু দাস ও তাঁর সহকর্মীরা দেখছেন, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ বা কর্নাটকের হাতুড়েরা রোগ নির্ণয় ও যথাযথ চিকিৎসা করার নিরিখে বিহার-ঝাড়খণ্ড-উত্তরপ্রদেশের পাশ-করা ডাক্তারদের চাইতে ভাল।
আর পশ্চিমবঙ্গ? জিষ্ণু উত্তর দিচ্ছেন, ভারতের সব রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ডিগ্রিহীন ডাক্তার আর পাশ-করা ডাক্তারের চিকিৎসার মানে ফারাক সব চাইতে কম। সেই মান কেমন? যক্ষ্মা, গর্ভবতীর প্রি-এক্লাম্পসিয়া (উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা) আর ডায়ারিয়ার চিকিৎসা অন্তত ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে যথাযথ হচ্ছে তামিলনাড়ু আর কেরলের গ্রামে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে যথাযথ চিকিৎসা হয়েছে যথাক্রমে ৬৭, ৫৩ ও ৭২ শতাংশ। তার অর্থ, এ রাজ্যের গ্রামে পাশ-করা ডাক্তারদের চিকিৎসার মানও সন্তোষজনক নয়।
ভাল মান কিসের উপর নির্ভর করে তা হলে? গবেষকরা বলছেন, যে সব রাজ্যে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বেশি, সেখানে ডিগ্রিহীনদেরও চিকিৎসার মান তুলনায় উন্নত। তাঁদের ব্যাখ্যা, ভাল ডাক্তারদের সঙ্গে কাজ করতে করতে ডিগ্রিহীন ডাক্তাররা শিখছেন, তার পর প্রতিযোগিতা করে রোগী টানছেন। তাই তাঁদের মানও ভাল হচ্ছে। এমন সব তথ্য সরকারি নীতির মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারে।
কেবল নয়া নীতি নয়, নীতির পুনর্বিবেচনাও করা চাই। উন্নত মানের চিকিৎসা সবার কাছে পৌঁছতে বেসরকারি হাসপাতালের উপর ভরসা করেছিল কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী জনআরোগ্য যোজনা গরিবের স্বাস্থ্যবিমা করিয়ে সে সুযোগ দিতে চেয়েছিল। কোভিড দেখাল, সে আশা কত ঠুনকো ছিল। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ বেড আর ৮০ শতাংশ ভেন্টিলেটর নিয়ে কোভিড রোগীদের ১০ শতাংশেরও চিকিৎসা করল না প্রাইভেট হাসপাতাল। একই পিপিই কুড়ি জনকে বিল করা, বিপুল অগ্রিম দাবি, আইসিইউয়ের মাত্রাছাড়া দর, কোভিড রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া, এর কোনওটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি কেন্দ্র বা রাজ্য। কার্যত দিনে ডাকাতি করছে বেসরকারি ক্ষেত্র।
কী লাভ হল স্বাস্থ্যবিমায়? কোভিড রোগীদের অতি নগণ্য অংশ জনআরোগ্য যোজনায় চিকিৎসা করিয়েছেন। সার্বিক ভাবে গত কয়েক মাসে বিমার ক্লেম কমে গিয়েছে ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ স্বাধীন ভারতের সব চাইতে বড় স্বাস্থ্য সঙ্কটে গরিবের স্বাস্থ্যবিমা, যার বার্ষিক প্রিমিয়াম ৬৪০০ কোটি টাকা ধার্য হয়েছে, তা কাজেই লাগল না। বিশেষজ্ঞরা বহু বার সতর্ক করেছেন, পরিকাঠামো তৈরি না হলে বিমায় লাভ হবে না। কেন্দ্র শোনেনি, তার গুনাগার দিতে হচ্ছে নাগরিককে।
এতগুলো সাফল্য-ব্যর্থতার তথ্যও যথেষ্ট নয়? মোদী সরকারের তথ্য-ক্ষুধা অপরিমিত। নিন্দুকে বলে, তার কারণ নীতি নয়, নজরদারি। নইলে কর্মহারা মানুষের কাছে খাবার পৌঁছনোর চাইতে আধার কার্ড-রেশন কার্ড সংযুক্তি জরুরি হবে কেন? স্বাস্থ্য কার্ড আবশ্যক, বলা হয়নি বটে— তবে ‘ঐচ্ছিক’ বলে যা শুরু হয়, তা কী ভাবে ‘অপরিহার্য’ হয়ে ওঠে, মোবাইল ফোন বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের আধার-সংযুক্তি নিয়ে সে অভিজ্ঞতা নাগরিকের হয়েছে। তাই প্রশ্ন, নির্বাচিত সরকার কি মানুষের কাজ করবে? না মানুষকে কাজে লাগানোই তার কাজ? এই দুঃসময়ে আরও একটা কার্ড নয়, আর একটা বেড-এর ব্যবস্থা করুক সরকার।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus health card
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy