শাসক ‘উল্টোপাল্টা প্রশ্ন’ পছন্দ করে না, মানুষের প্রশ্ন করার স্পৃহাকে সে সর্বদা দমিয়ে রাখতে চায়। তবুও কিছু মানুষ শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ঘুণ ধরা সমাজকে পাল্টানোর দাবি তোলেন, শাসককে প্রশ্নবাণে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে প্রতিস্পর্ধী হওয়ার সাহস দেখান।
আর এই প্রতিবাদীদের একেবারে সামনের দিকে থাকে উত্তাল আঠারো। কারণ ‘এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়’। ‘ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ’ তামাদি হয়ে গিয়েছে কবেই। ছাত্রেরা বুঝতে পেরেছেন, শাসকের পছন্দসই এই লব্জ আসলে ‘মগজে কারফিউ’ জারি করার ছল। কিন্তু যাঁরা প্রশ্ন করতে শিখেছেন সব কিছুকেই, তাঁরা কেন বিনা তর্কে, বিনা বিচার-বিবেচনায় সব কিছু মেনে নেবেন? এই মেনে না-নেওয়ার তাগিদ থেকেই সব ভেদবুদ্ধি ও স্বার্থের সংঘাত অস্বীকার করে শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রেরা বারবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এ দেশে কিংবা বিদেশে। গত শতাব্দীতে তো বটেই, এই শতাব্দীতেও। তাঁদের আন্দোলন কখনও সফল হয়েছে, কখনও বা ব্যর্থ। তা বলে তাঁদের ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রচেষ্টায় ছেদ পড়েনি কোনও দিনই।
গত শতাব্দীর প্রথম থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছিল ভারতীয় ছাত্রসমাজ। ১৯১৮ সালের সিডিশন কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ১৯০৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত বাংলার ১৮৬ জন বিপ্লবী বন্দিদের মধ্যে ৬৮ জনই ছিলেন ছাত্র। পরবর্তী কালে সাইমন কমিশন বয়কটকে সফল করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন ছাত্ররাই, রশিদ আলি দিবস পালন কিংবা নৌ-বিদ্রোহের সমর্থনের ক্ষেত্রেও তাঁরা সাধারণ কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্তের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন। স্বাধীন ভারতে ছাত্রেরাই সমস্ত বিপদ তুচ্ছ করে জড়িয়েছেন নকশালবাড়ি আন্দোলনে জড়িয়েছেন বা সরব হয়েছেন দেশে জারি হওয়া জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে।
গোটা দুনিয়ায় ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস আজকের নয়। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নাৎসি অপশাসনের বিরুদ্ধে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সূচনা করেছিলেন ‘হোয়াইট রোজ’ বা ‘শ্বেত গোলাপ’ আন্দোলনের। ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রেরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলেন ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এবং সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার ও আরও অসংখ্য ছাত্র-তরুণের প্রাণের বিনিময়ে সে দাবি আদায়ে তাঁরা সফলও হয়েছিলেন।
১৯৬৭-৬৮ সাল জুড়ে একের পর এক ছাত্র আন্দোলনের অভিঘাতে কেঁপে উঠেছে সারা বিশ্ব। ভিয়েতনামে আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সে দেশের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন কিংবা সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালের মার্চে পোল্যান্ডের ছাত্র আন্দোলন অথবা ওই বছরের মে মাসে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গলের পদত্যাগের দাবিতে প্যারিসের সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা খুব পুরনো নয়। সরকারের স্বচ্ছতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, শিল্প-কারখানায় নিয়োজিত কর্মীদের অধিকারের দাবি-দাওয়া নিয়ে ১৯৮৯ সালের জুনে কমিউনিস্ট চিন কেঁপে উঠেছিল ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে; রাষ্ট্রীয় মদতে সংঘটিত হয়েছিল তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের গণহত্যা।
সদ্য ঘটে যাওয়া বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কিছু দিন আগের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের উপরে মারাত্মক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে ছাত্র আন্দোলনের বিশ্বব্যাপী ইতিহাস আজ আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। হস্টেল ও সিমেস্টারের ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রায় দু’মাস ধরে আন্দোলন চালাচ্ছেন জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রীরা। সেই আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য গত ৫ জানুয়ারির রাতে ক্যাম্পাসে ঢুকে এক দল অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী তাণ্ডব চালায়। সাবরমতী ছাত্রাবাসে ঢুকে লোহার রড, বাঁশ, লাঠি দিয়ে মারধর করা হয় পড়ুয়াদের। রডের আঘাতে গুরুতর আহত হন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি ঐশী ঘোষ-সহ অন্তত ৩৪ জন। এমনকি তাণ্ডবকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করতে গিয়ে আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী ও বর্তমান অধ্যাপিকা সুচরিতা সেন।
আহত পড়ুয়াদের খোঁজও নেননি উপাচার্য জগদেশ কুমার। উল্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে একাধিক এফআইআর করা হয়েছে ঐশী-সহ ২০ জনের নামে। কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান জেএনইউ-এর দায়িত্বে রয়েছে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এবং পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। যে দিল্লি পুলিশ এর দিন কয়েক আগে জামিয়ার গ্রন্থাগারে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের পিটিয়েছে, তারা জেএনইউ হামলার সময় ছাত্রছাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টাটুকু করেনি। কাপড়ে মুখ ঢাকা দুষ্কৃতীরা জেএনইউ ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালানোর পরে এত দিন পেরোলেও এখনও এক জনকেও গ্রেফতার করেনি অমিত শাহের নিয়ন্ত্রণে থাকা দিল্লি পুলিশ। ওই হামলার কোনও সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়নি বলেও দাবি করেছে তারা। তাণ্ডবকারীদের আড়াল করা ছাড়া এর আর কী উদ্দেশ্যই বা থাকতে পারে? এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে যে, সহসা এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে কেন? উত্তরটা সহজ। দেশ জুড়ে একের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়ারা কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বনাশা সিএএ, এনপিআর, এনআরসি-র বিরোধিতায় নেমেছেন। কোনও রাজনৈতিক নেতানেত্রী কিংবা দলের পরোয়া না করে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাঁরা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে সর্বশক্তিমান শাসকের দিকে। এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, এই সমবেত প্রতিবাদ যে প্রতিরোধের আগুনে পরিবর্তিত হতে পারে, সে কথা সম্যক বুঝছে শাসক। বেগতিক বুঝে এনআরসি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যের বিপরীত কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং।
এই প্রতিরোধের আগুন যাতে কিছুতেই আমজনতার মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে না পড়তে পারে, সেই কারণেই ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-কে রাষ্ট্রীয় মদতে টুকরো করার চক্রান্ত চলছে পুরোদমে। কিন্তু জনগণ জাগছে। সারা দেশ সমালোচনা, ধিক্কার, নিন্দা, প্রতিবাদে তোলপাড় হয়ে উঠেছে। এখনও যদি মনে করি যে এ আক্রমণের নিশানা কেবল ছাত্ররাই, তা হলে মূর্খের স্বর্গে বাস করছি আমরা। কারণ, যে কোনও দিন এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের শিকার হতে পারি আমি কিংবা আপনি। তাই এই ফ্যাসিস্ট আচরণের বিরুদ্ধে জোট বাঁধুন, নইলে
শিয়রে শমন অপেক্ষা করছে। মনে রাখতে হবে—
“সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে,
শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে,
সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে
লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়।”
লেখক: আমঘাটা শ্যামপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy