পৃথিবী নামক গ্রহের টগবগে ফুসফুস দাউদাউ করে ক্রমাগত জ্বলছে সেই অগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে। জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে বন-বনাঞ্চল। ধোঁয়া ধোঁয়া আকাশ ছেয়ে অনর্গল পাখিদের ক্রন্দন। দগ্ধ চারণভূমি জুড়ে বন্যপ্রাণীদের আধপোড়া লাশের সহবাস। পৃথিবীর আদিম জংলি অসহায় মানুষগুলো ছুটে বেড়াচ্ছে ভয়াল ভয়ঙ্কর জঙ্গলের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে... জীবনের তরে। জীবনপোড়া গন্ধে মম করছে মৃত্যু অববাহিকা। আর এই গ্রহের সর্বোৎকৃষ্ট জীব হিসেবে আধুনিক মননশীল মানুষেরা অলক্ষ্যে থেকে শুধু লক্ষ্য রাখছে মরণের কাছে জীবনের অসহায় নিবেদনের বায়স্কোপ!
অ্যামাজন বৃষ্টিবন, যার মোট আয়তন কমবেশি ৫৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। যার ব্যাপ্তি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল, পেরু, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডর, গায়না, সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্চ গায়না, এই নয়টি দেশ জুড়ে। আমাজন বৃষ্টিবনের ৫৮.৪% অঞ্চলই ব্রাজিলে অবস্থিত। বাকি ১২.৮% ছড়িয়ে রয়েছে অন্য দেশগুলিতে।
আমাজন বৃষ্টিবনে প্রায় ৪০,০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রায় ৩,০০০ প্রজাতির মাছ, প্রায় ১,৩০০ প্রজাতির পাখি, ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। এ ছাড়াও বিস্তীর্ণ আমাজন অববাহিকা জুড়ে প্রায় ৪০০ প্রজাতির আদিবাসী জনজাতির গর্ভগৃহ।
ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র National Institute for Space Research (INPE)-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এখনও পর্যন্ত আমাজনের জঙ্গলে মোট ৭২,৮৪৩-টি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে, যা গতবছরের থেকে ৮৩% বেশি এবং ২০১৩ সাল থেকে আজ অবধি রাখা দাবানলের পরিসংখ্যানের মধ্যে সর্বাধিক। জঙ্গলে দাবানল নতুন কোন ঘটনা নয়। দাবানল জঙ্গলের একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া মাত্র। প্রকৃতির রোষানলেই দাবানলের দহন এবং প্রকৃতির কৃপাতেই দাবানল নির্বাপণ। কিন্তু ধন্দ লাগে, যখন দেখি প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে হুহু করে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে জঙ্গলাকীর্ণ সবুজ বৃক্ষবন, জঙ্গল নিবাসী অসংখ্য বন্যপ্রাণী, জীবনের সন্ধানে জঙ্গল ঢুঁড়ে ফেলা জঙ্গলেরই ভূমি-সন্তান আদিম মানুষগুলো, অথচ বিশ্বমনন এখনও পর্যন্ত কেবল দর্শকের ভূমিকাতেই ক্ষান্ত। ততটা সরব নয় বিশ্বসংবাদমাধ্যমও। স্থানীয় প্রশাসনও তথৈবচ। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, একটা বৃষ্টিবনে একটি বছরে এত বার কী ভাবে আগুন লাগে?
আগুন যদিও বা লাগে, আমাজনের মতো বৃষ্টিমুখর একটি জঙ্গলে এই আগুনের স্থায়িত্ব এত বেশি হয় কী ভাবে? ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, জায়ের বোলসোনারও আমাজন জঙ্গলে আগুন লাগার জন্যে এনজিও-দের দায়ী করেছেন। তাঁর বক্তব্য— এনজিও-দের জন্য বরাদ্দ অর্থ সঙ্কোচন করার কারণেই এনজিও-রা প্রতিহিংসাবশত জঙ্গলে বারবার আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এক জন রাষ্ট্র প্রধানের কাছ থেকে একটি গুরুতর সমস্যার সুলুক সন্ধানে এত সরলীকরণ হতবাক করে দেয়! বরং, অন্য একটি মহল থেকে আমাজন জঙ্গলে আগুন লাগার পেছনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগের তির আনা হচ্ছে। এ কথা বিশ্বের অজানা নয় যে, আমাজন জঙ্গলের মাটির নীচে প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের বিপুল সম্ভার। জঙ্গল বাঁচুক বা নাই বাঁচুক, এই খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য পুঁজিবাদের বদান্যতায় ফুলে ফেঁপে ওঠা বহুজাতিক সংস্থাগুলো সদাই উদগ্রীব। আর তার জন্য শুধু প্রয়োজন রাষ্ট্রের ‘সহানুভূতিশীল হাত’। সন্দেহ করা হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বহুজাতিক সংস্থাগুলো আমাজন জঙ্গলের মাটির নীচ থেকে খনিজ সম্পদ নিষ্কাশনের প্রথম ধাপ হিসেবেই এই ঘন ঘন অগ্নি সংযোগের বন্দোবস্ত। যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল অরণ্যবিনাশ এবং জঙ্গলের ভূমি-সন্তান আদিবাসী জনজাতিদের জঙ্গল থেকে সমূলে উৎপাটন এবং পরবর্তী উদ্দেশ্য হল নির্বিঘ্নে জঙ্গলের মাটির নীচ থেকে খনিজ সম্পদ নিষ্কাশনের মাধ্যমে আহরণ। এই সন্দেহ কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। আমাদের দেশেও তো দণ্ডকারণ্যে কিংবা ওড়িশার নিয়মগিরির জঙ্গলাকীর্ণ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই একই পদ্ধতিতে আদিবাসী উৎপাটনের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর যুগলবন্দির জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত রয়েছে। জঙ্গলের মাটির নীচের প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ জঙ্গলের জলস্তরকে ধরে রাখার মাধ্যমে জঙ্গলের ভারসাম্য রক্ষা করে। জঙ্গলের মাটির নীচ থেকে প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ নিষ্কাশনের অমোঘ ফল হল জঙ্গলের জলস্তরের আস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটানো।
ফলস্বরূপ জঙ্গল শুকিয়ে যায় এবং পরিশেষে ধ্বংস হয়ে যায়। জঙ্গলের ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল বন্যপ্রাণীরা এবং ভূমি-সন্তান আদিবাসী জনজাতিরা। ফলে, জঙ্গল যদি শুকিয়ে যায়, ধ্বংস হয়ে যায়, তবে প্রত্যক্ষভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় বন্যপ্রাণীরা এবং আদিবাসী জনজাতিরা। আর তাতে কি বা এসে যায় মুনাফা-সন্ধানী বহুজাতিক সংস্থাগুলোর এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের!
কিন্তু তাতে কি বেঁচে যেতে পারব আমরা? জঙ্গল বলতে যাঁদের কাছে কেবলই বিনোদনভূমি এবং ভ্রমণ বিলাসিতার চারণক্ষেত্র, জঙ্গলাকীর্ণ জনপদ থেকে সহস্র যোজন দূরে ডিজিটাল জগতের প্রমোদভূমিতে স্বাচ্ছন্দ্যের বিলাসিতায় মোড়া নিরাপদ আধুনিক মানুষেরা! আমাজন বৃষ্টিবন এ পৃথিবীর প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের ২০% সরবরাহ করে। পৃথিবীর আকাশে বাতাসে ভাসতে থাকা অন্যতম প্রধান গ্রিন হাউস গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃহৎ বিশোষক। আমাজন জঙ্গল যদি সত্যি কোনও দিন ধ্বংস হয়ে যায়, শুধু বন্যপ্রাণী বা বন্য মানুষেরাই নয়, আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে মোড়া ভোগবাদে পরিপুষ্ট এই গ্রহের আধুনিক মানুষদেরও বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে। এই উপলব্ধিটা আমাদের যত তাড়াতাড়ি হবে, এই গ্রহের পক্ষে ততই মঙ্গল!
বিশ্বের ধনী দেশগুলো এখনও পর্যন্ত তেমন ভাবে আমল দেয়নি আমাজন অরণ্যের এই বিষম বিপর্যয়ের খবর চাউর হওয়া সত্ত্বেও। তবে বলিভিয়া ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আকাশপথ থেকে জল নিক্ষেপের মাধ্যমে আমাজন অরণ্যের অগ্নি নির্বাপণ করার প্রচেষ্টার। অতি সম্প্রতি জি-সেভেনের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো আমাজন জঙ্গলাকীর্ণ দেশগুলোকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যে আর্থিক সাহায্য অনুমোদন করেছে এবং আমাজন বৃষ্টিবনকে রক্ষা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টার পথ নির্ণয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে এই প্রচেষ্টা কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা সময় বলে দেবে। আমাজন অরণ্যের সিংহভাগ যে দেশের মানচিত্র জুড়ে রয়েছে, সেই ব্রাজিলের রাষ্ট্র প্রশাসন এখনও পর্যন্ত তেমন একটা নড়েচড়ে বসেনি।
INPE-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ব্রাজিলের অন্তর্গত আমাজন বৃষ্টিবনে গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত যে পরিমাণ অরণ্যবিনাশ হয়েছে, এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত তার থেকে ৮৮ শতাংশেরও বেশি পরিমাণ অরণ্যবিনাশ ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। তবে ঘরে-বাইরের প্রবল চাপে অবশেষে ব্রাজিল সরকার দুটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানের সাহায্যে জল নিক্ষেপ করে আমাজন বৃষ্টিবনের মধ্যে জ্বলে ওঠা আগুন নির্বাপণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বিশ্বসংবাদমাধ্যমও শীত ঘুমের আড়মোড়া কাটিয়ে এখনও উঠতে পারেনি। মনোভাব খানিকটা যেন এই রকম, আমাজন জ্বলছে জ্বলুক, আমরা তো তাতে দগ্ধ হচ্ছি না। কিন্তু এ ভাবে এড়িয়ে গিয়ে এই ভয়াবহ আগুনের আঁচ থেকে আমরা কি আদৌ পালিয়ে বাঁচতে পারব?
লেখক : শিক্ষক, এসআর ফতেপুরিয়া কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy