Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
michael madhusudan dutt

ডিয়ার রাজাসাহেব... আবেদন ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গের’

একটি চিঠিতে দরখাস্ত পাঠিয়েছিলেন মাইকেল। আর কোচবিহারের রাজা নরেন্দ্র নারায়ণের কাছে তাঁর চাকরির সুপারিশটি করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এমনই ঐতিহাসিক পত্রের কথা লিখছেন নমিতেশ ঘোষএকটি চিঠিতে দরখাস্ত পাঠিয়েছিলেন মাইকেল। আর কোচবিহারের রাজা নরেন্দ্র নারায়ণের কাছে তাঁর চাকরির সুপারিশটি করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এমনই ঐতিহাসিক পত্রের কথা লিখছেন নমিতেশ ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০২:৫৩
Share: Save:

একটি চিঠি। তার নীচে নাম লেখা: মাইকেল এম এস দত্ত। তারিখ: ২৭ জানুয়ারি, ৬০ (১৮৬০)।
আজ থেকে ১৬০ বছর আগে এই চিঠি এসে পৌঁছেছিল কোচবিহারের মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণের কাছে, ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরির জন্য দরখাস্ত নিয়ে। আবেদনকারীর পুরো নাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আর তাঁর নাম সুপারিশ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
১৬০ বছরের পুরনো সেই চিঠির আলোচনা এখনও ঘুরে বেড়ায় কোচবিহারে। বিদ্যাসাগর ও মাইকেল যেন কিছুক্ষণের জন্য চলে আসেন রাজ্যের এই প্রান্তিক শহরে। যেন মনে হয়, তাঁদের সঙ্গে এক আন্তরিক সম্পর্ক ছিল এখানকার মাটির। সম্পর্ক তো অবশ্যই ছিল। না হলে মাইকেল কী করেই বা কোচবিহারের মহারাজাকে ‘মাই ডিয়ার রাজাসাহেব’ বলে উল্লেখ করেন। না হলে মহারাজের কাছে পাঠানো সুপারিশে বিদ্যাসাগর লিখেতেন না, “একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাঠাইলাম, দেখিও যেন বাতাসে উড়িয়া না যায়।” শেষ পর্যন্ত সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, মাইকেল মধূসূধন দত্ত আর চাকরি নিতে আসেননি। হলে হয়তো তাঁর অকালমৃত্যু হত না— কোচবিহার এখনও এমন কথাই মনে করে। হয়তো আরও কিছু দিন চলত তাঁর কলম।
কোচবিহারের সঙ্গে এমন ভাবে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল বিদ্যাসাগর ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের। ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায়, বিদ্যাসাগর, মাইকেল এবং কোচবিহারের মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন সমসাময়িক। তিন প্রান্তের এই তিন মানুষের যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল মহানগরী কলকাতাতেই। বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। তাঁর শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন কলকাতাতেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। একদিকে, সমাজ সংস্কারক, অন্যদিকে গদ্যকার বিদ্যাসাগর ছুঁয়ে যেতে থাকেন সমস্তস্তরের মানুষকে। তাঁর লেখা ‘বর্ণপরিচয়’। তাঁর বিধবাবিবাহ ও স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা নিয়ে আন্দোলনে গোটা সমাজকে নাড়িয়ে দেওয়া। এই প্রত্যন্ত কোচবিহারে বসেও সেই বিদ্যাসাগরের কথা তাই মানুষ আজও বলেন। অনেকটা একই সময়ে জন্মেছিলেন মাইকেল মধূসূদন দত্ত। যশোর জেলার সাগরদাড়ি (বর্তমানে বাংলাদেশ) গ্রামে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্মেছিলেন তিনি। সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্মেও শেষ জীবন কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছিলেন তিনি। যা তাঁকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে। মাত্র ৪৯ বছর বয়সেই মৃত্যু হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের।
ওই সমসাময়িক ছিলেন মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণ। তাঁর পড়াশোনা কলকাতা ও কৃষ্ণনগরে। এমনটাই উল্লেখ রয়েছে নানা গ্রন্থে। তা সেই যা-ই হোক, কেন এই সবের স্মৃতিচারণা? আসলে বিদ্যাসাগরের সুপারিশ করা মাইকেলের ওই একটি মাত্র চিঠিতে যেন কত কথার উল্লেখ রয়ে গিয়েছে। ওই চিঠিতেই স্পষ্ট হয়েছে এই তিন মানুষের নানা দিক। ইতিহাসচর্চা থেকেই জানা যায়, ১৮৬০ সালে কোচবিহারের রাজ প্রশাসনে ম্যাজিস্ট্রেট পদে চাকরির আবেদন করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ওই আবেদন প্রসঙ্গেই রাজ প্রশাসনের উদ্দেশে নিজের লিখিত মতামত জানিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। সেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রশংসা করেছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, “একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাঠাইলাম, দেখিও যেন বাতাসে উড়িয়া না যায়।” আরও জানা যায়, মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণের আমলে রাজ প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রকাশ হয় ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকায়। ওই বিজ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতেই মাইকেল চাকরির আবেদন করেছিলেন। ১৮৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি পাঠানো ওই আবেদনপত্রে মহারাজাকে ‘মাই ডিয়ার রাজা সাহেব’ বলে সম্বোধন করেন মাইকেল। ‘মধুসূদন রচনাবলী’তে মহারাজাকে ওই সম্বোধন করে চিঠির উল্লেখ রয়েছে। এই চিঠি থেকে স্পষ্ট, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কোচবিহারের মহারাজার পরিচয় ছিল। শুধু পরিচয় ছিলই নয়, তা এতটাই দৃঢ় ছিল যে, সে জন্যেই বিদ্যাসাগর সুপারিশ করেছিলেন। কোচবিহারের মহারাজা বলতেই কিছু স্পষ্ট দৃশ্য ফুটে উঠে। প্রজাকল্যাণে মহারাজাদের ভূমিকা আজও মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়।
আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, বিদ্যাসাগর ছিলেন ‘দয়ার সাগর’। তাঁর দুয়ার থেকে কেউ কখনও ফিরে যেতেন না। তা আমাদের প্রায় সবারই জানা। এ কথাও আমরা জানি যে, কী ভাবে তিনি মাইকেল মধুসূধনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
মাইকেল এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মেছিলেন। ছোট বয়সেই কলকাতায় পড়াশোনা করেন তিনি। বাবার চাকরিসূত্রে ছোটবেলায় থেকে কলকাতায় বসবাস করতেন। পড়াশোনা করতেই করতেই তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর বিধর্মী পুত্রকে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করেন। পরে মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই) গিয়ে একটি ইংরেজি শিক্ষার স্কুলে চাকরি শুরু করেন। সামান্য বেতন পেতেন। তা দিয়ে দিনযাপন করা তাঁর পক্ষে কষ্টকর ছিল। আরও কিছুটা স্বচ্ছল হওয়ার জন্য ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। সেই সঙ্গেই চালিয়ে যান পড়াশোনা। ১৮৬০ সালেই তিনি ফ্রান্সের ভার্সেই নগরীতে যান। সেখানে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। সেই সময় বিদ্যাসাগর তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মাইকেল বিদেশে ঋণগ্রস্ত হয়ে বিদ্যাসাগরের কাছে সাহায্য চান। সেই সময় বিদ্যাসাগর নিজে টাকা ধার করে মাইকেলকে সাহায্য পাঠান।
সেই অবস্থার হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিলেন মাইকেল নিজেও। সে জন্যেই তিনি চাকরির চেষ্টা শুরু করেন। বিজ্ঞাপন দেখেই তিনি কোচবিহার মহারাজার অধীনে চাকরির জন্য আবেদন করেন। মাইকেলের ওই কাজ যাতে হয়, সে জন্যেই বিদ্যাসাগর সুপারিশ করেছিলেন কোচবিহারের মহারাজাকে। হয়তো তিনি জানতেন কোচবিহার মহারাজাদের মহানুভবতার কথা। হয়তো সে জন্যেই তাঁর আস্থা ছিল অপরিসীম। আর তিনি জানতেন মাইকেলকেও। আর তাই লিখেছিলেন, “একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাঠাইলাম, দেখিও যেন বাতাসে উড়িয়া না যায়।” এই কথা ক’টিই বুঝিয়ে দেয়, মাইকেলকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বলেই মনে করতেন ঈশ্বরচন্দ্র। ইতিহাসের পাতায় সেই চিঠির থেকে যাওয়া থেকে বোঝা যায়, এই তিন জনের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান কতটা ছিল। শুধু বিদ্যাসাগরের সুপারিশটি কোথায়, তা আজও কেউ জানে না।
অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র

অন্য বিষয়গুলি:

Michael Madhusudan Dutt Iswar Chandra Vidyasagar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy