একটা লোক মোড়ে বসে ঝিমোচ্ছে। পড়শি ছুটে এসে বলল, ‘‘শিগগির চল, আগুন লেগেছে।’’ লোকটা বলল, ‘‘আমার কী?’’ পড়শি বলল, ‘‘আরে, তোমারই বাড়িতে!’’ উত্তর এল, ‘‘তোমার কী?’’ এই গল্পের লোকটার মতোই কি উদাসীন পশ্চিমবঙ্গের চাষি? যে কৃষি আইন নিয়ে পঞ্জাব-হরিয়ানার চাষি ‘গেল গেল’ রব তুলেছেন, ভাঙন ধরেছে শাসকজোটে, স্বয়ং রাহুল গাঁধী ট্র্যাক্টরের স্টিয়ারিং ধরলেন, তা নিয়ে বাংলার গ্রামে কোনও সাড়া নেই। পাইকারি, খুচরো বাজারে কেবল আলুর চড়া দাম নিয়ে খুশির গুলতানি। বাংলার চাষি কি বোঝেননি কৃষি সংস্কারের অর্থ?
না কি শহুরে তাত্ত্বিক আর পেশাদার প্রতিবাদীরা বাংলার চাষের প্রকৃত পরিস্থিতির খোঁজ না করে আপন আবেগে বিভীষিকাময় ভবিষ্যতের ছবি এঁকে চলেছেন, তাই বাংলার চাষি পাত্তা দিচ্ছেন না?
পঞ্জাবের চাষিদের রাগ, আইন সংশোধন করে নিয়ন্ত্রিত বাজারের (এপিএমসি) বাইরে কৃষিপণ্যের লেনদেন চালু করেছে কেন্দ্র। তাঁরা বড় চাষি, নিয়ন্ত্রিত বাজারের রাশ রাখতেন নিজেদের হাতে। একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ঘা লাগলে চটারই কথা। কিন্তু বাংলায় বেচাকেনার সামান্যই হয় নিয়ন্ত্রিত বাজারে। সে সব বাজার থেকে ফি মেলে সামান্যই (৮২ কোটি টাকা, ২০১৮)। না-ই এল ওই টাকা, চাষির কী?
‘গেল গেল’ রব উঠেছে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন তুলে দেওয়াতে। আশঙ্কা, এ রাজ্যের ফসল অবাধে যাবে অন্য রাজ্যে, মজুতদারিও বাড়বে। বাজার আগুন হবে। সেটা ক্রেতার জন্য ঝুঁকি বটে, কিন্তু চাষি, কৃষিব্যবসায়ীর লাভ। তবু ধরা যাক, চাষিও ক্রেতা, তার স্বার্থেও দাম নিয়ন্ত্রণ চাই। তা করুক না সরকার, আটকাচ্ছে কোথায়? ২০১৪ সালে তৃণমূল সরকার যখন রাজ্যের সীমান্তে আলুর ট্রাক আটকেছিল, তখন অত্যাবশ্যক পণ্য আইন কাজে লাগানো হয়নি তো! স্রেফ পুলিশ দিয়ে আলু ধরেছিল সরকার। ট্রাক ওভারলোড হয়েছে, দূষণের কাগজ নেই, এমন নানা কেস দিয়ে রাজ্যের আলুর প্রায় ১৫ শতাংশ আটকানো হয় সে বছর। কৃষিপণ্যের রফতানি আটকাতে চাইলে রাজ্য তা পারে, আইনের জন্য আটকায় না। কৃষিপণ্যের দাম কমানোর আর একটা উপায়, সরকারি ভাবে কিনে বাজারে বিক্রি। বামফ্রন্ট, তৃণমূল, সকলেই তাই করছে।
রাজ্যের ক্ষমতা খর্ব হল বলে মাথা না চাপড়ে প্রশ্ন করুন, অত্যাবশ্যক পণ্য আইন কতটুকু উপকার করেছে রাজ্যবাসীর? তৃণমূল জমানায় মাত্র বার দুয়েক অত্যাবশ্যক পণ্য আইন কাজে লাগিয়েছে সরকার। ২০১৪-১৫ সালে, ডালের জন্য। আর গত বছর, পেঁয়াজের জন্য। ২০০৬-২০১১’র মধ্যে বামফ্রন্ট প্রয়োগ করেছে বলে মনে করতে পারলেন না বাম নেতারা। আসলে দাম নিয়ন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত আইনের জোরে হয় না, হয় রাজনৈতিক ক্ষমতায়। বড় ব্যবসায়ীদের সংগঠন মানেই শাসক দলের সংগঠন। কতটা মজুত হবে, কতটা ছাড়া হবে, কত দামে, সে সিদ্ধান্তের পিছনে একটা রাজনৈতিক দর কষাকষি থাকে। এ বছর আলু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কৃষি বিপনন দফতর সাত বার মিটিং করেও ব্যর্থ হয়েছে আলুর দাম কমাতে। আধিকারিকদের একাংশের ধারণা, নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ীদের উপর চাপ তৈরি করতে দ্বিধা করছে শাসক দল। কারণ যা-ই হোক, আইনের অভাব কারণ নয়।
কৃষিপণ্য বিষয়ক নতুন আইনে ‘এমএসপি’-র কোনও উল্লেখ নেই বলে পঞ্জাবের চাষিরা ভয় পাচ্ছেন। সে রাজ্যে ৯৫ শতাংশ চাষি সরকারকে ধান-গম বিক্রি করেন। বাংলায় সরকারি খরিদের আওতায় রয়েছেন মাত্র ৩০ শতাংশ চাষি। রাজ্যের রেশনব্যবস্থা চালু রাখতে গেলে যে ধানটুকু চাই, তা-ই কেনে সরকার। তা হলে বাংলার চাষি সরকারি খরিদ বন্ধ হওয়ার ‘ভবিষ্যতের ভূত’ দেখবেন কেন?
সব চাইতে বড় নীলচাষের ভূত। নতুন কৃষি আইন চুক্তিচাষকে বৈধতা দিয়েছে। আশঙ্কা, এ বার কর্পোরেট নামবে নীলকর হয়ে। চাষি বাধ্য হবেন কোম্পানির নির্দিষ্ট-করা ফসল, কোম্পানি-নির্দিষ্ট দামে কোম্পানিকেই বেচতে। স্বাধীন চাষি পরিণত হবেন দাস শ্রমিকে। এই ভয়ানক সম্ভাবনাকে পরখ করা যাক চাষির অভিজ্ঞতা দিয়ে। গত পনেরো বছর একটি বহুজাতিক সংস্থার আলু চাষ করছেন বাংলার চাষি (২০০৩ সালে অনুমোদন দেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু)। ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৫,৩০০ একর জমিতে চাষ হত ‘কোম্পানির আলু’। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৯,৫০০ একর। আলু কেনা হয়েছে এক লক্ষ টন, জড়িত ১১ হাজার চাষি। বাঁকুড়ার জয়পুরের চাষি তপন আচার্য ‘প্রসেসিং ভ্যারাইটি’ আলু ফলাচ্ছেন ১৫ বছর। জানালেন, জয়পুর আর কোতুলপুর, এই দুই ব্লকের হাজারখানেক চাষি নিয়মিত ওই আলু চাষ করছেন। অধিকাংশই কিছু জমিতে কোম্পানির আলু, কিছুটাতে বাজারি আলু চাষ করেন। বাজার খারাপ থাকলে কোম্পানির দাম ক্ষতি থেকে বাঁচায়, বাজার চড়া হলে কপাল খোলে জ্যোতি, চন্দ্রমুখী বেচে। ‘‘খুব বিজ্ঞানসম্মত চাষ। হার্ভেস্টার যন্ত্র ব্যবহারে উৎসাহ দেয় কোম্পানি, তাতে ফলন ভাল হয়।’’ হুগলির তারকেশ্বরেও যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে একই কারণে, বললেন বিদ্যুৎ মাইতি। বারো বছর আগে তালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে ‘কোম্পানির চাষ’ শুরু করেন তঁারা চার-পাঁচ জন। আজ করছেন চারশো চাষি।
এই দুই চাষিরই ধারণা, চুক্তিচাষ নিয়ে ভয় অমূলক। জমি তো চাষিরই থাকছে। লাভ নেই, মনে করলে চুক্তি না করলেই হল। কোম্পানির তরফে চাষিদের নিয়ে মিটিং করে শর্ত জানানো হয়। ‘চাপিয়ে দেওয়া’ চাষ হলে বছর বছর চাষ বাড়ত না। বস্তুত আগ্রহী চাষি অনেক বেশি। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের চিপসের চাহিদা অনুসারে আলুর বীজ দেয়। পণ্যের বাজার নির্ধারণ করছে চাষের প্রসার।
এই জন্য দেড় দশক পেরিয়েও ‘কোম্পানির আলু’ বাংলার মোট আলুর এক শতাংশও নয়। আলুর জমির চার-পাঁচ শতাংশে তা চাষ হয়। কর্পোরেট সংস্থা বাংলার কৃষিবাজার দখল করবে, এমন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিলেন সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়। একটি বাণিজ্যিক চেম্বারের কৃষি বিভাগের এই সদস্য বলেন, ‘‘ফসল কেনা, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপননে বিপুল বিনিয়োগ চাই। ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা সীমিত, জলবায়ুর অস্থিরতায় উৎপাদন অনিশ্চিত, কৃষিশিল্পের পরিকাঠামো দুর্বল। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রকে দখল করতে কেন নামবে কর্পোরেট?’’ এই মুহূর্তে প্রশ্ন এই নয় যে, বাংলার চাষকে কর্পোরেট দখল করবে কি না। প্রশ্ন হল, বাংলার কৃষিতে সে আদৌ আগ্রহী হবে কি না।
বাংলার চাষির বিপদ কৃষির নয়া সংস্কারে নয়, সংস্কারের অভাবে। নয়া আইনে সে উপেক্ষিত। ঠিকাচাষি, সবজিচাষি, ফুল-ফলচাষি কী করে সরকারি ভর্তুকি, ঋণ পাবেন, কী করে বাজার ধরবেন, সেই প্রশ্নগুলো পাত্তা পায়নি নয়া সংস্কারে। বিরোধী নেতারাও কর্পোরেট-বিরোধিতার বাঁধানো রাস্তাটি ছেড়ে বাংলার চাষির আয় বাড়ানোর উপায় খোঁজার এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় পা দেওয়ার কষ্টটা করবেন না। রাজনৈতিক বিরোধিতা তাঁদের লক্ষ্য। চাষি নিমিত্তমাত্র। বিপদ বোঝাতে এলে বাংলার চাষি তাই বলেন, ‘‘তোমার কী? আমারই বা কী?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy