Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Post Editorial

কৃষি বিল: সুরক্ষা না দুর্দশা !

সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হওয়ার পর থেকেই ‘কৃষি বিল ২০২০’-র বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে নানা মহলে। বিশেষত, এই বিল আইনে পরিণত হলে দুর্দশার সিঁদুরে মেঘ দেখছেন জেলার কৃষকরা। কিন্তু কেন? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলেন দিগন্ত মান্নাকৃষকদের একাংশ মনে করছেন ‘দ্য এসেনসিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামিডমেন্ট অর্ডিন্যান্স) বিল’ আসলে সরকারি সহায়ক মূল্য তুলে দেওয়ার গোড়াপত্তন। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য কেনার দায় সরকার নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। কৃষকদের একাংশের যুক্তি, বর্তমানে সরকার কৃষকদের যে পরিমাণ সহায়ক মূল্য দেয়, তা বেসরকারি সংস্থা বা কোনও ব্যবসায়ী দেবেন না।

পাঁশকুড়ার গোপীমোহনপুর গ্রামে পলি-হাউস পদ্ধতিতে চলছে পালং চাষ। নিজস্ব চিত্র

পাঁশকুড়ার গোপীমোহনপুর গ্রামে পলি-হাউস পদ্ধতিতে চলছে পালং চাষ। নিজস্ব চিত্র

দিগন্ত মান্না
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:৪৭
Share: Save:

বিরোধীদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সংসদের উভয় কক্ষেই পাশ হয়ে গিয়েছে ‘কৃষি বিল ২০২০’। এখন বিলে রাষ্ট্রপতি সই করলেই, তা আইনে পরিণত হবে। যা কেবলই সময়ের অপেক্ষা। নয়া কৃষি বিলের বিরোধিতায় দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে আন্দোলন। বিজেপি বিরোধী দলগুলি কার্যত এই বিলের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে। প্রশ্ন হল, কী এমন রয়েছে এই বিলে যা নিয়ে এত আপত্তি? কৃষক সংগঠনগুলির দাবি, এই বিল আসলে কৃষকদের স্বার্থ বিরোধী। কর্পোরেট সংস্থা ও বড় ব্যবসায়ীদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্যই এই বিল। এখনও পর্যন্ত কৃষি বিল সম্পর্কে যে তথ্য সামনে এসেছে, তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন কৃষকরা।

সংসদের দুই কক্ষ লোকসভা এবং রাজ্যসভায় পাশ হয়ে গিয়েছে ‘দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন)’, ‘দ্য ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিয়োরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস’ এবং ‘দ্য এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামিডমেন্ট অর্ডিন্যান্স) বিল ২০২০’। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য একাধিক হাত ঘুরে এসে পৌঁছয় বড় ব্যবসায়ী বা বেসরকারি সংস্থার কাছে। ‘দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) বিল’-এ বলা হয়েছে নতুন কৃষি আইন কার্যকর হলে বড় ব্যবসায়ী বা বেসরকারি কোনও সংস্থা চাইলে সরাসরি চাষির কাছ থেকে কৃষিজ পণ্য কিনে নিতে পারবে। সরকারের যুক্তি, এর ফলে কৃষকরা বাজারের সর্বোচ্চ মূল্য পাবেন।

‘দ্য ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল’-টি হল আসলে চুক্তিভিত্তিক চাষ বিষয়ে। এই বিল অনুযায়ী কোনও বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থা বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা চাইলে কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে সেই জমিতে কৃষিজ পণ্য ফলাতে পারবে। জমির চুক্তি অনুযায়ী কৃষক দাম পেয়ে যাবেন। কৃষক নিজের জমিতে কাজ করতে চাইলে, তার জন্য দৈনিক পারিশ্রমিকও মিলবে। সরকারের যুক্তি, এতে দেশীয় কৃষিজ পণ্যের চাহিদা বাড়বে। কৃষি পণ্য রফতানির পথ প্রশস্ত হবে। অন্য দিকে, ‘দ্য এসেনসিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামিডমেন্ট অর্ডিন্যান্স) বিল’ অনুযায়ী এ বার থেকে সরকার চাল, ডাল, গম, ভোজ্য তেল, তৈলবীজ ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সামগ্রীর মজুতের ঊর্ধ্বসীমা বলে কিছু রাখছে না। অর্থাৎ এ বার থেকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ঘুরপথে চলে যাচ্ছে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে। এই বিলে বলা হয়েছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সামগ্রীর দাম ৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেলে তখন সরকার চাইলে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কোনও বেসরকারি সংস্থা কৃষিজ পণ্য সংরক্ষণের জন্য হিমঘর তৈরিতে আগ্রহী থাকে, সরকার তাদের ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেবে।

এই তিনটি বিল পাশ হওয়ার পর তীব্র বিরোধিতায় নেমেছেন কৃষকরা। দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে আন্দোলন। কৃষকদের যুক্তি ‘দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) বিল’ কার্যকর হলে বড় ব্যবসায়ী ও মজুতদাররা হয়তো একসঙ্গে বেশি কৃষিজ পণ্য কিনবেন, কিন্তু তারা আদৌ বাজারের সর্বোচ্চ দাম দেবেন না। দেশের কৃষিজ পণ্য বেশি করে বিদেশে রফতানি হয়ে গেলে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন ঠিকই, কিন্তু বাজারে তৈরি হবে খাদ্য সঙ্কট। এ ছাড়া ‘দ্য ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল’ নিয়েও খুশি নয় কৃষক মহল। তাদের যুক্তি, এই বিল অনুযায়ী কৃষক নিজের জমিতেও ক্রীতদাস হয়ে যাবে। ভেড়ির মালিকরা যেমন জোর করে জমি কেড়ে নেয়, একদিন তেমন কৃষককে বেসরকারি সংস্থাকে জমির লিজ দিতে বাধ্য করা হবে।

কৃষকদের একাংশ মনে করছেন ‘দ্য এসেনসিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামিডমেন্ট অর্ডিন্যান্স) বিল’ আসলে সরকারি সহায়ক মূল্য তুলে দেওয়ার গোড়াপত্তন। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য কেনার দায় সরকার নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। কৃষকদের একাংশের যুক্তি, বর্তমানে সরকার কৃষকদের যে পরিমাণ সহায়ক মূল্য দেয়, তা বেসরকারি সংস্থা বা কোনও ব্যবসায়ী দেবেন না। চাষিদের আরও আশঙ্কা, এই বিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্যশস্য মজুতের দায়ও কমিয়ে ফেলতে চাইছে। পাশাপাশি নতুন বিল আইনে পরিণত হলে কৃষিজ পণ্য বাজার কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকা মান্ডিতে বিক্রি করার কোনও বাধ্যবাধকতা থাকবে না। দেশের ২৫০টি কৃষক সংগঠন একটি যুক্ত মঞ্চ করে আগামী ২৫ তারিখ দেশ জুড়ে গ্রামীণ ভারত বন্‌ধের ডাক দিয়েছে। ‘অল ইন্ডিয়া কিসান ও খেত মজদুর সংগঠন’-এর রাজ্য সম্পাদক পঞ্চানন প্রধান বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য এই বিল এনেছে। এই বিল কৃষক স্বার্থ বিরোধী। হরিয়ানা, পঞ্জাবের মতো আমাদের রাজ্যের কৃষকদেরও এই বিলের বিরোধিতায় আগামী ২৫ তারিখ বন্‌ধে সামিল হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’’ কৃষি বিলের বিরোধিতা করেছে কৃষক সংগ্রাম পরিষদও। সংগঠনের সম্পাদক নারায়ণচন্দ্র নায়ক বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার অবিলম্বে এই বিল প্রত্যাহার না করলে, আমরা কৃষকদের নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করব।’’

কৃষি বিলের বিরোধিতা শুরু হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরেও। মঙ্গলবার থেকে ওই বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। এ দিন মেদিনীপুরে বিক্ষোভ-অবস্থান করেছে তৃণমূল। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতির দাবি, ‘‘এই বিলের ফলে আগামী দিনে শুধু কৃষকের নয়, ক্ষতি হবে সাধারণ মানুষেরও।’’ সিপিএমের কৃষক সংগঠন সারা ভারত কৃষকসভার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা শাখা আগামী শুক্রবার পথ অবরোধের ডাক দিয়েছে। ওই দিন জেলার তিন জায়গায় জাতীয় সড়ক অবরোধ হবে বলে জানিয়েছেন কৃষকসভার জেলা সম্পাদক মেঘনাদ ভুঁইয়া। মেঘনাদ বলেন, ‘‘এই বিল কৃষক স্বার্থ বিরোধী। আমরা ওই দিন জাতীয় সড়ক অবরোধ করব। আগামী দিনে আন্দোলন আরও তীব্র হবে।’’ কংগ্রেসের জেলা সভাপতি সৌমেন খানের কথায়, ‘‘এর ফলে কৃষকেরা ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন।’’

বিজেপির অবশ্য দাবি, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার পথে এই বিল কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না। বিজেপির পশ্চিম মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি শমিত দাশের দাবি, ‘‘বিল নিয়ে মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে।’’ একই দাবি বিজেপির ঘাটাল সাংগঠনিক জেলার সভানেত্রী অন্তরা ভট্টাচার্যেরও। তবে তৃণমূলের দাবি, রাজ্য সরকার সব সময়ে কৃষকদের পাশে রয়েছে। যুক্তি হিসেবে তারা জানাচ্ছে, ইতিমধ্যে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ৫,৭৪,৮৬৮ জন কৃষকের হাতে কিসান ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে চাষের খরচের মূলধন জোগানের ব্যবস্থা হয়েছে। জেলার ৪,৭৮,৩২১ জন কৃষককে কৃষকবন্ধু প্রকল্পের সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। জেলার চার লক্ষ চার হাজার ৪৫৯ জন কৃষককে শস্যবিমার সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। কৃষি বিলের প্রসঙ্গে কেশপুরের চাষি সনাতন ঘোষ, শালবনির চাষি অজয় মাহাতো প্রমুখ বলেন, ‘‘আমরা যাতে ফসলের ন্যায্য দাম পেতে পারি, সরকারের উচিত সে ব্যবস্থা করা।’’

তথ্য সহায়তা: বরুণ দে

অন্য বিষয়গুলি:

Farmer Bill Post Editorial Diganta Manna
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy