জয়দেব মেলায় বাউলদের আখড়া। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
লোকসংস্কৃতি শব্দটির মধ্যে দু’টি শব্দের সমাহার, লোক ও সংস্কৃতি। লোক বলতে বোঝায় সাধারণ মানুষ বা জনসাধারণ। সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে মানুষের উন্নততর জীবনযাপনের সামগ্রিক প্রয়াস ও সৃজনশীলতা। সমাজবিকাশের ধারায় এই প্রয়াস এবং সৃজনশীলতার বিকাশ সদা পরিবর্তনশীল। সংস্কৃতি বিকাশের এই ধারায় প্রথমেই আসে আদিম সংস্কৃতি এবং পরবর্তী কালে লোকসংস্কৃতি ও শিষ্টসংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতি হল সমষ্টিগত জীবনচর্চা ও বৈদ্ধিক বা মানসচর্চার ফসল। এই সংস্কৃতি হল ঐতিহ্যবাহী এবং বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত। এই ঐতিহ্যবাহী ও বংশপরম্পরা প্রবাহিত চর্চাগুলি হল আচার, আচরণ, রীতি-নীতি, উৎসব অনুষ্ঠান, সামাজিক প্রথা প্রভৃতির সমাহার। লোকসংস্কৃতিকে আলোচনার সুবিধার জন্য নানা শ্রেণিতে ভাগ করা যায় যথা মৌখিক সাহিত্য, লোকাচার, লোকশিল্প ইত্যাদি। লোকসংস্কৃতির ভিতরে মৌখিক সাহিত্যের মধ্যে পড়ে লোকসঙ্গীত। আবার লোকসঙ্গীত প্রদর্শনমূলকও। লোকসঙ্গীতের সঙ্গীত অংশ সাহিত্য আর গায়কি অর্থাৎ সুর,লয়, তাল ও উপস্থাপনা যথা নৃত্য প্রদর্শনমূলক। বাউল বা ফকির গান সেই অর্থে প্রকৃত লোকসঙ্গীত।
নবী মহম্মদকে সাধনার পূর্বসুরি ধরে ফকির সাধনার পরম্পরা চলে আসছে। অন্য দিকে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব ও তাঁর সাধনার ধারাকে আধার ধরে বাউল সম্প্রদায় আজও সাধনায় রত। শিয়া, সুফিরা গুপ্তজ্ঞানের এক প্রবাহকে আলি-ফতেমার মাধ্যমে চিহ্নিত করে তার উত্তরাধিকার বহন করেন। আর বৈষ্ণব গুপ্ত সাধন কড়চায় চৈতন্যদেব, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত ও অন্যান্য বৈষ্ণব মহাজনদের দেহ সাধনার বিবিধ আচরণ বাউল সাধনার অঙ্গ। উভয় সাধনারই মূল ভিত্তি প্রেম। আর সেই প্রেম হল বিরহ-মিলনের কাম গন্ধহীন অমর প্রেম।
এই বাউল এবং ফকির সাধনার এক মিলনক্ষেত্র হল বীরভূমের জয়দেব-কেঁদুলির মেলা। এই মেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন মেলা। খুবই অনাড়ম্বর ভাবে পৌষ সংক্রান্তিতে অজয় নদের ঘাটে পুণ্যার্থী মানুষের সমাবেশ থেকেই এই মেলার জন্ম। কিন্তু কালক্রমে নানা মানুষ, সম্প্রদায়, সংস্থা, আখড়া এবং সরকারি সহায়তায় এই মেলার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে জয়দেব-কেঁদুলির মেলা পশ্চিমবঙ্গের বৃহৎ মেলাগুলির মধ্যে একটি। এই মেলার একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক তাৎপর্য আছে। বিশেষত, লোকসংস্কৃতি। মেলার সংস্কৃতি মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেও বাউল-ফকির গান এই মেলার মুখ্য আকর্ষণ। বাউল সম্প্রদায় মেলার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এই কারণেই অনেকে বর্তমানে জয়দেব-কেঁদুলির মেলাকে বাউল মেলা হিসেবেও চিহ্নিত করে থাকেন। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে এই মেলার একটি তাত্ত্বিক ও আত্মিক যোগ আছে।
জয়দেব-কেঁদুলির মেলা বাউল মেলা হিসাবে বিবেচিত হওয়ার তাত্ত্বিক উৎস সন্ধানের চেষ্টা করা যেতে পারে। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, “অষ্টাদশ শতাব্দে প্রভু শ্রীনিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র সহজিয়া মানুষদের বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে নিয়ে আসেন। তারা তখন বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায়। আর তাদের থেকে এসেছে বাউলেরা।” অন্য দিকে, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ‘গৌড়বঙ্গ সংস্কৃতি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— “জয়দেবের আবির্ভাবের পূর্বেই বৌদ্ধ সহজযানের সাধনতত্ত্ব রাঢ়দেশে বিশেষ জনপ্রিয় হইয়াছিল। এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের একটি শাখা শ্রীপাদ নিত্যানন্দের প্রভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহারাই বৈষ্ণব সহজিয়া নামে পরিচিত।”
যাই হোক প্রধানত সহজিয়া বৈষ্ণব থেকেই এসেছে বাউল সম্প্রদায়। বৈষ্ণব সহজিয়াদের সাধনার মূল ভিত্তি রাধাকৃষ্ণের প্রেমবিরহের লীলা মাহাত্ম্য। জয়দেব-কেঁদুলিতে শ্রী শ্রী রাধামাধবের যুগল মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে জয়দেব পদ্মাবতী নিষ্কাম সাধনা করেন। আর এখানেই মিল বাউলের সঙ্গে আরাধ্য দেবতা ও তাঁর লীলা বন্দনায়। অন্য দিকে সুফি সাধকেরাও প্রেমধর্মের উদার মতবাদে বিশ্বাসী। সে বিশ্বাস আবার জয়দের শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দ রচনার ভিত্তি। এই কারণেই বাউল সম্প্রদায় কবি জয়দেবকে নিজেদের গুরু এবং নবরসিকদের এক জন রসিক মনে করে থাকেন। জয়দেব গবেষক পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য যথার্থ লিখেছেন,
“তিনিই আবার রাধাকৃষ্ণের পরম ভক্তিমান।
শোনেন জলাল মখদুমের লায়লা-মজনুর গান।।”
চৈতন্য সমসাময়িক কালে বাস্তব জীবন সম্পর্কে উদাসীন, বাইরের দিক থেকে অসম্বন্ধ, ঈশ্বরভক্ত সম্প্রদায় হল বাউল। ধর্ম ও উপধর্মের ‘কায়া সাধনাতত্ত্ব’ অবলম্বন করে এই সম্প্রদায় সাধন ও ক্রিয়াকর্ম অনুশীলন করে। আর কেঁদুলির মেলা বাউল সংস্কৃতিতে সম্পৃক্ত। জয়দেব মেলায় আগত বাউল-ফকিরেরা ভাব-ভাবনার এক প্রদীপ থেকে শত প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের সূত্রধর। জীবনচর্চায় ও মহাজনী গানে তাঁরা রচনা করেন এক কল্পলোক। উত্তর পুরুষকে দেখান এক অনাগত স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন দুঃখের পরাপার পার হওয়ার, শোকতাপহীন এক মানব প্রেমের মহাভাব অনুভব করার।
বাউল-ফকিরের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গানের প্রসার ঘটেছে। কিন্তু, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পণ্যমূল্য। ইউনেস্কো বাউল গানকে বিপন্ন মূল্যবান লোকসংস্কৃতি হিসেবে ঘোষণা করেছে। অনেক সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বাউল গান রক্ষা ও সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছে। বেসরকারি উদ্যোগে ১৯৮০ সালে তৈরি হওয়া ‘পদ্মাবতী গীতি সংস্থা’ এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। জয়দেবে বাউল অ্যাকাডেমি গড়া হয়েছে। আশা করা যায়, এই লোকসংস্কৃতির গবেষণা ও সংরক্ষণে এই অ্যাকাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আশার কথা, জীবনচর্চায় নিজ মূল্যবোধের উপরে অবিচল সাধক-গায়কের অভাব নেই। আজও রচনা করে চলেছেন বহু জনপদ, সৃষ্টি হচ্ছে নিত্য নুতন সুর। তৈরি হচ্ছে পরম্পরা। যার মূল ভাবনা মানবধর্ম। ‘লালনের গান ও মানবতাবাদ’ গ্রন্থের লালন গানের এই ভাবনার মূল সুরটি ধরা আছে,
“ আমি মরছি খুঁজে সেই দোকানের সহজ ঠিকানা
যেথা আল্লা হরি রাম কালী গড্
এক থালাতে খান খানা।…”
তাই জয়দেব মেলা এক দিকে যেমন অজয় নদে মকর সংক্রান্তির দিনে পুণ্যার্থীদের মকর স্নান করে গঙ্গা স্নানের সমান পুণ্য অর্জন করার মেলা, অন্য দিকে তেমনই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে আখড়ায় আখড়ায় গানের অনুষ্ঠান, বাউলের আসর, একতারা, দোতারার সুর নিয়েই জয়দেব মেলা। পূর্বাঞ্চল লোকসংস্কৃতি কেন্দ্রের অনুষ্ঠান,পুরুলয়ার ছৌনৃত্য, রাইবেশে, লালন-ফকিরের গান পশ্চিমবঙ্গের সুমহান লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে। সাহিত্য সংসদ বা সাহিত্য পরিষদের ‘সহিত্য বাসর’ গ্রামীণ সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এই সব কারণেই জয়দেব মেলা সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টির মাধ্যমে ধার্মিক পরিবেশে বাংলার লোকসংস্কৃতির বিকাশেরও এক তীর্থস্থান।
লেখক বিশ্বভারতীর উপ-গ্রন্থাগারিক,
মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy