হালফিল সুন্দরবনের সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করা এবং সেগুলি সমাধানের পথ বাতলানোর জন্য সুন্দরবনকে নিয়ে সারা দুনিয়ায় বিশেষজ্ঞরা নানা ধরনের সমীক্ষার কাজ করে চলেছেন। সমীক্ষাগুলির অধিকাংশই আমি দেখেছি। দীর্ঘ সুন্দরবনবাসের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে যে, অনেকগুলি সমীক্ষাতেই সুন্দরবনের জঙ্গল এবং মানুষের বাস্তব অবস্থা জেনে সমাধানের সুপারিশ করা হয়নি। সমীক্ষাগুলির একটা বড় অসুবিধা হচ্ছে যে, কে কার কাছ থেকে তথ্য নিয়েছেন বা জনজীবন সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তা বোঝা মুশকিল। আর একটা দিক হচ্ছে, এই সমীক্ষাগুলিকে বাস্তবের ভিত্তিতে সামগ্রিক ভাবে বিচার-বিবেচনা আজও করা হয়নি। এগুলি দেশে-বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রি করার কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। সুন্দরবনের কাজে খুব একটা আসেনি। এ দেশেও কোনও সরকারি সংস্থা বিভিন্ন সমীক্ষার যথার্থ মূল্যায়ন করে সুন্দরবনের সমস্যা সমাধানের কাজে হাত দেননি।
গোটা সুন্দরবনের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। বাইরে ও ভিতর, দুটো দিক থেকেই সুন্দরবনের জঙ্গল ও সমাজকে বিধ্বস্ত করার চেষ্টা চলছে। বাইরের আঘাতগুলির সৃষ্টি হয়েছে নানা ভাবে বিশ্ব পরিবেশ দূষণ থেকে। যেমন, ১) বিশ্ব আবহাওয়া পরিমণ্ডল গরম হয়ে ওঠার ফলে বরফের পাহাড় গলে সমুদ্রে জলের পরিমাণ বাড়ছে এবং তা উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিকে বিপন্ন করে তুলছে। সুন্দরবনের মতো ‘ভালনারেব্ল’ অঞ্চলে তা একেবারে শেষ স্তরে গিয়ে ধাক্কা দেয়। গত দুই দশকে ভারতের অংশে যে-সুন্দরবন, তার মধ্যে রেডফোর্ড, সুপারীভাঙ্গা, কাবাসগাদী এবং লোহাচড়া— এই চারটি দ্বীপ সমুদ্র গিলে খেয়েছে। গত দুই দশকে সুন্দরবনের নদীগুলির জলস্তর বছরে ৩.১৪ মিলিমিটার করে বা়ড়ছে, যেখানে পৃথিবীর বার্ষিক গড় ২ মিলিমিটার। এই জলস্তর বৃদ্ধির কারণগুলিকে বন্ধ না করা হলে সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ সহজেই অনুমেয়।
২) দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে সুনামি-আয়লার মতো প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাত। গত চার শতকে সুন্দরবন অঞ্চল প্রায় ৬৪টি বড় ধরনের ঝড়ের আঘাত সয়েছে। গত শতাব্দীতে এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ডতা ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩) সুন্দরবনে সাড়ে তিনশোর বেশি প্রজাতির গাছ পাওয়া যেত, ৯৮টি ম্যানগ্রোভ জাতের। দেশে ম্যানগ্রোভ জাতীয় বনের প্রায় ৬৮ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে। আবহাওয়ামণ্ডলের সর্বনাশা শক্তিগুলির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের জঙ্গল এবং পশুপাখিও বিপন্ন। যেমন, সুন্দরীগাছ থেকে সুন্দরবন নাম হয়েছিল, এখন সেটার কিছু প্রজাতি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে। বাঘ এবং অন্যান্য প্রাণীও সংখ্যায় কমতে শুরু করেছে। এই সমস্যাগুলির কোনওটিই সুন্দরবনের মনুষ্যসৃষ্ট নয়। বিশ্ব জুড়ে যাঁরা এর স্রষ্টা, তাঁরা প্রায় প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে মহোৎসব করে এগুলির সমাধানের চেষ্টার কথা ভাবেন, কিন্তু কোনও দেশই প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক হতে পারে না, তাই সমস্যা মেটে না, বরং আবহাওয়াকে বিষাক্ত করে তোলার উপাদানগুলির জোগান বেড়ে যায়।
ভিতরের আঘাতে আসি। পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবনের ১০২ দ্বীপের মধ্যে ৫৬টি দ্বীপের জঙ্গল পুরো হাসিল করে প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ বসবাস করছে। ৪৮টি দ্বীপে মাত্র বনাঞ্চল। এই যে মানুষের সুন্দরবন, সেখানে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস করছেন, দীর্ঘ সুন্দরবনবাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, ক্রমেই তারা সুন্দরবনের ওপর আস্থা হারাচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই দ্বীপগুলিতে বাস করতে পারবে, এই বিশ্বাস ক্রমেই তাদের চলে যাচ্ছে। তার একটি প্রধান কারণ হল, এর বাইরের আঘাতগুলি মাঝে মাঝেই তাদের অস্তিত্বকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন মূলত একফসলি দেশ, এর অর্থনীতি তাই প্রধানত কৃষি-নির্ভর। অন্যান্য ভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধির সুযোগ অতি সীমিত। উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলি হচ্ছে জমি, জল ও জঙ্গল। একফসলি হওয়ায় জমিতে যা উৎপাদন হয়, তাতে মানুষের ন্যূনতম চাহিদাগুলি মিটিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বড় শিল্প এখানে হবে না। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প থেকে আয় বাড়াবার সুযোগ নেই বললেই চলে। জল জঙ্গল থেকেও মাছ-মধু-মোম জ্বালানি কাঠ— সব কিছুর জোগান কমছে। এক ইঞ্চি চাষযোগ্য জমি বাড়েনি, অন্য দিকে ভূমিক্ষয়ের শিকার। সেচের সুযোগ বাড়িয়ে দ্বিতীয় ফসলের চাষ ১৫-২০ শতাংশ জমির বেশি নয়। জমিতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল জাতের ধান বা অন্য ফসল চাষ দুটো জিনিস করছে, ক) জমিতে উৎপাদনের হার ক্রমেই কমছে। যথেচ্ছ কীটনাশক ও ওষুধের ব্যবহার এক দিকে জমির উর্বরতাকে কমাচ্ছে, অপর দিকে নানা রোগ-ব্যাধির জন্ম দিচ্ছে। খ) জমিতে উৎপাদনের ব্যয় তুলনায় প্রচুর বেড়েছে। ১৪-১৫ বিঘা জমির মালিকও নিজে চাষ না করলে ৫ জনের সাংসারিক ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। ১০০ দিনের কাজ এ সমস্যায় স্থায়ী সমাধান নয়। চাষযোগ্য জমি কমছে, মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে প্রকৃতির কোলে প্রকৃতিজাত ও নিয়ন্ত্রিত দ্বীপবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন: মানুষগুলি ভোগজ্বরে আক্রান্ত । গ্রামে যে সামাজিক ব্যবস্থা ৩০-৪০ বছর আগেও দেখেছি, সেই বন্ধন আজ অনুপস্থিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আনন্দ এমনকী সামাজিক দায়বদ্ধতা— সবই পণ্য হয়ে যাচ্ছে। এখন সুন্দরবনের মানুষ নিজেরা আনন্দ সৃষ্টি করে না, আনন্দ কেনে। পোশাক-আশাক, চিকিৎসা, সব কিছুই পণ্য। শ্রদ্ধা-প্রীতি-ভালবাসাও। উন্নয়নের চেষ্টা একেবারে হচ্ছে না তা বলব না। কিন্তু গাঁধীজি, রবীন্দ্রনাথ উন্নয়ন বলতে বোঝাতে চেয়েছিলেন মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলা। প্রকৃতি যত সামগ্রী দিয়ে নিজেকে ভরিয়ে তুলেছে, তার সুষ্ঠু ব্যবহার করে উৎপাদন ও ভোগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ কথা তাঁরা বলেছিলেন। অনুদান-ভিত্তিক এবং বিচ্ছিন্ন ভাবে সুন্দরবনের কোনও সমস্যার সমাধানই বোধহয় সম্ভব না। সেটা নিয়ে একটা সমগ্রিক চিন্তা এবং তার ভিত্তিতে ‘প্রায়রিটি’ অনুযায়ী পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ হয়তো বিপর্যয় থেকে কিছুটা রক্ষা করতে পারে।
সুন্দরবনের মানুষ এখন সুন্দরবন ছাড়তে চাইছেন। এ সমস্যা ও তার সমাধানের চেষ্টার সঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক— সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে এ মানুষগুলিকে সংঘবদ্ধ করাটাই আজ বোধহয় বড় কাজ। এটা একটা লড়াই, বাঁচার লড়াই। ভিক্ষাজীবী হয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো যায় না। দরিদ্র শ্রেণির মানুষ হাজারে হাজারে, কাতারে কাতারে সুন্দরবন ছেড়ে পালাচ্ছেন। যাঁরা একটু অবস্থাপন্ন বা মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী, তাঁরাও সুন্দরবনের আস্তানা ছেড়ে শহরের উপকণ্ঠে বা বস্তিতে অমানবিক জীবনযাপন করছেন। এই ভিতরের এবং বাইরের আঘাত ঠেকাতে গেলে সুন্দরবনের মানুষকে এই বিষয়গুলি জানতে হবে এবং বাঁচার শেষ লড়াইটা লড়তে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy