—ফাইল চিত্র।
অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল নিয়মিত ঘটনা। ১৭৭০-এর অগস্টে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে পৌঁছে সেখানকার দাবানল দেখে ক্যাপ্টেন জেমস কুক এর নাম দিয়েছিলেন ‘ধুম্র মহাদেশ’। ১৮৫১ থেকে সংগ্রহ করা নথিতে আছে প্রায় ৭০টা দাবানল, আটশো লোকের মৃত্যুর কথা। সমগ্র অস্ট্রেলিয়া জুড়েই মাঝেমধ্যে ছোটখাটো দাবানল লেগেই থাকে, তবে অধিকাংশই হয় দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে। গত বছর সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া দাবানল আজও জ্বলছে। গত বছরের শুরুতেই নিউ সাউথ ওয়েলসে দুটো দাবানল হয়েছিল; ২০০৬-০৭ সালে একই অঞ্চলে আগুন লেগে পুড়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। ১৯৭৪-৭৫’এর দাবানলে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় পনেরো শতাংশ এলাকা ভস্মীভূত হয়েছিল।
মানুষের কোনও পূর্ব প্রজাতি অস্ট্রেলিয়া পৌঁছতে পেরেছিল কি না জানা যায় না, তবে সংগৃহীত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন মতে আনুমানিক ৪৭ হাজার বছর আগে মানুষের বসবাস ছিল অস্ট্রেলিয়া-সহ এখনকার নিউ গিনি, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া ও তাইল্যান্ডে। তখন শেষ হিমবাহ যুগ শুরু হয়েছে, দুই মেরু এলাকায় বরফ জমতে শুরু করেছে, সমুদ্রে জলের মাত্রা নামছে। জলের মাত্রা নামায় যে সব মানুষ এশিয়ায় ঢুকে আরও পূর্বে চলে এসেছিল, তারা ইন্দোনেশিয়া ও নিউ গিনি হয়ে সাগর পেরিয়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়া। ভারত থেকে সমুদ্রের তীর ধরে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলোতে এবং অস্ট্রেলিয়ায় যে মানুষ গিয়েছে তা ওয়াই-ক্রোমোজোম পরীক্ষায় প্রমাণিত। এ সময়কার পলিতে ও বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেশি পাওয়া গিয়েছে। তবে আবহাওয়া শুষ্ক ও শীতল হয়ে যাওয়ার কোনও প্রামাণ্যতা নেই। অনুমান, জঙ্গলে অনবরত আগুন লেগে কার্বন মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। দাবানলের সঙ্গে সেই সময় মানুষের ব্যাপক আগুনের ব্যবহারও কারণ হতে পারে। সংগৃহীত কাঠকয়লার নমুনাই এমন অনুমানের কারণ।
অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়ায় আগুনই প্রধান শক্তি, আগুন লাগলে অল্প সময়েই তা দাবানলের চেহারা নেয়। তবে শুধু হাওয়াই যে আগুন ছড়ায় তা নয়। আগুনের মধ্যেই তৈরি হয় একটা শূন্যতা যার মধ্যে আগুন ঢুকে ঘূর্ণি তৈরি করে, অনেকটা টর্পেডোর মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তখন। সে যুগের মানুষেরা লক্ষ করেছিল, হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে আগুন লাগিয়ে বনাঞ্চল পরিষ্কার করা যায়। তাতে খাদ্যের জন্য শিকারেও সুবিধে। আরও পরে সেই ফাঁকা জমিতে আলু, অন্যান্য খাদ্যশস্য ফলাত তারা। হাজার হাজার বছর ধরে তারা এ ভাবেই মানুষ আগুন জ্বালিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করেছে। আবার ইগল ও ফ্যালকনের মতো শিকারি পাখিও করে জ্বলন্ত আগুনের কাঠি মুখে এনে উঁচু ঘাসজমিতে ফেলে দিত। তাতে আগুন লেগে বিশাল এলাকা জুড়ে ঘাস পুড়ে যেত, মাটির নীচে বা ওপরে থাকা ছোট জন্তুরা বেরিয়ে আসত, পাখি পেত তার খাবার।
ইউরোপীয়রা এখানে আসার পর থেকে আগুন নিজেদের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করল, তাতে বেড়ে চলল বিপর্যয়। বাতাসে বেড়ে যাওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইডের মোকাবিলায় আঞ্চলিক আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ইত্যাদি না-মেনে যত্রতত্র গাছ লাগানোয় আগুন লাগলে গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ায় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, এই শতকের গোড়াতেই এমনটা ধরা পড়েছে। এও দেখা গিয়েছে, প্রচুর পরিমাণ গুল্ম জাতের গাছ লাগানোর ফলে তা শুকিয়ে গেলে খুব দ্রুত আগুন ছড়ায়। গাম্বা নামের এক ধরনের ঘাস বাইরে থেকে এনে কুইন্সল্যান্ড এলাকায় লাগানো হয়েছিল। এই ঘাস জ্বালানির কাজ করে, ফলে আগুন লাগলে তা নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে। দেরিতে হলেও ইউরোপীয়রা আদি অধিবাসীদের আগুন নিয়ন্ত্রণের প্রণালী বুঝতে পেরেছে, সেই মতো এখন অনেক জায়গায় কাজ চলছে। ইউক্যালিপটাসের মতো তেল যে সব গাছে আছে এবং যে সব বীজ আগুনের সহায়ক, অরণ্য তৈরির কাজে তাদের ব্যবহার বন্ধ হয়েছে।
মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে নিরক্ষরেখার কাছাকাছি তৈরি ‘এল নিনো’র প্রভাব অস্ট্রেলিয়ার ওপর বেশি। তাতে বৃষ্টি কমে যায়, আবহাওয়া তপ্ত হয়, তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন হয়। সাধারণত পূর্ব ও দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় এর প্রভাব প্রকট, তাই ওই সব জায়গা কয়েক বছর অন্তর খরা ও দাবানলের শিকার হয়। জলবায়ু পরিবর্তন এ বারের দাবানলের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, যদিও নিশ্চিত প্রমাণ নেই। পৃথিবী গরম হয়ে উঠছে প্রাকৃতিক কারণেই। এখন উষ্ণ যুগ চলছে, কিন্তু প্রকৃতির স্বভাবই এমন যে এই উষ্ণ যুগের মাঝে অন্তর্বর্তীকালীন শৈত্য যুগ আসে কিছু সময়ের জন্যে। প্রকৃতির এই সাম্য বজায় রাখার খেলাকে যদি মানুষ তার একটি-দু’টি প্রজন্মে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা মনে করে বসে এবং নিজেই খোদকারি করতে যায়, তাতে ভারসাম্য নষ্ট হয়, যেমন হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় অরণ্য তৈরি করতে গিয়ে। দাবানল বিপর্যয়ের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। মানুষ পাহাড় সমতল করে খরা ডেকে আনছে, দোষ পড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর। বিজ্ঞানকে বাণিজ্যের হাতিয়ার না করে সংযত ব্যবহার করলে সবারই লাভ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy