প্রতীকী ছবি
তখন অবিভক্ত দিনাজপুরের তপনে। দুর্গাপুজো মানেই মণ্ডপে ঘর বাঁধা। পাশাপাশি নিজের গ্রামটাকেও অন্য সাজে দেখা। সারা বছর নিশ্চুপ দুপুর। দিনভর কোলাহল নেই। কাছেই শান্ত নদী। মাটির শীর্ণ রাস্তা। হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে শিউলি ফুল পাড়া। পাশে ঝোপে বসা প্রজাপতি। হাতে ধরে পাখার রং যাচাই। ফড়িংয়ের গা এড়িয়ে চলা। কাছ থেকে বকদের মাছ খোঁজা দেখা। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতেই কানে আসত শাঁখের আওয়াজ। তার পরে ঝুপ করে সন্ধ্যা। মুখস্থ ধারাপাতের জীবন।
‘মাতল রে ভুবন’-এর অনুভূতি মহালয়ার দিন। আগের রাতেই ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া হত। একটা নয়, দুটো ঘড়িতে। দাদা না আমার, কার অ্যালার্মে ঘুম ভাঙল তা নিয়ে টানাপড়েন চলত সারাবছর। তাই চ্যালেঞ্জ নিয়ে অ্যালার্ম দেওয়া। ভোরে একটু চোখ জুড়িয়ে গেলেও মাফ! কিন্তু কানের কাছে কালো রঙের রেডিয়ো চাই-ই চাই। উৎসবের মেজাজে বলা ওই শব্দগুলো না শুনলেই নয়! মানে তো বুঝতাম না। কিন্তু উৎসবের ভাষা চিনেছিলাম মহালয়ার সকালে। জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী। মনে গেঁথে গিয়েছে একদম। সে দিন সন্ধেয় পিকনিক ছিল ধরাবাঁধা। সেখানেই পুজোর চার দিনের যাবতীয় পরিকল্পনা করা হত।
বাড়ির ঠিক পাশের পুজোমণ্ডপ। পুজোর ঠাকুর কোথায় হচ্ছে জানা থাকত। খেলার মাঠে মণ্ডপ ও প্রতিমা শিল্পী নিয়ে চর্চা চলত। শিল্পীর গায়ে কোনও জামা থাকে না কেন? কে ওঁকে বিড়ি খেতে দেখেছে? এ নিয়ে বিস্তর তর্ক চলত। খড় আর কাঠামো কেমন জাদু হয়ে যেত দিন কুড়ির মধ্যে! এই ফাঁকে আমাদের নতুন জামা-কাপড় কেনা সারা। বালুরঘাট থেকে আসত সে সব। তার পরে শুধু অপেক্ষা।
ষষ্ঠির দিন থেকেই মণ্ডপে বসা শুরু। তখনও থিম পুজোর রমরমা শুরু হয়নি। আলোকসজ্জারও তেমন বাহার ছিল না। বাঁশ বেরিয়ে পড়া আড়ম্বরহীন মলিন কাপড়ে ঘেরা মণ্ডপ প্রাণের চেয়ে প্রিয় ছিল। এবং আমি তখনও জানতামই না ইদ বলে কোনও আলাদা উৎসব আছে। পুজোর আনন্দই ছিল সব। সারাদিন ফুরসত নেই। প্যান্ডেলে বসেই গান শোনা। পুজো দেখা। এটার বাইরে যে জীবন আছে সেটাই ভুলে যেতাম ওই ক’দিন। অষ্টমীর দিন যথারীতি অঞ্জলি দিতাম। দাদা খেয়ে নিলেও আমি খেতাম না।
প্রতিদিনই একটি করে প্রতিযোগিতা থাকত। ছোটদের নাটক, আবৃত্তি, গান, আঁকা। যদিও পুরস্কার আমার ভাগ্যে জোটেনি। তবুও আনন্দের সীমা ছিল না। দশমীর দিন কেমন মনখারাপ করত। সে দিন সকালটা বড্ডা ফাঁকা ফাঁকা লাগত। প্যান্ডেলের গানও কেমন বেসুরো ঠেকত। সন্ধেয় ঠাকুরের ভ্যানের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে ঘাট পর্যন্ত যেতাম। ‘দুর্গা মাই কি জয়’ বা ‘আসছে বছর আবার হবে’ আমি উচ্চারণ করতে পারতাম না। চোখ দুটো ভারী জ্বালা করত। সবাই বলত, মা শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেলেন। বুঝতে পারতাম না, জল দিয়ে আবার কী করে যাবেন! ভেসে গেলেন তো! ফেরার সময় খুব কষ্ট হত। তবে মা যে বাপের বাড়িতে ছিলেন এটা শুনতে ভাল লাগত। মানে, আমাদের কাছেই তো ছিলেন।
তপনের যে স্মৃতি ছিল দুর্গাপুজোর তা নানা শহরে ঘুরতে ঘুরতে বদলে গিয়েছিল। সেই আপন করে নেওয়ার ব্যাপারটা কম ছিল। নিষ্পাপ মন অনেক কিছু বুঝতে শিখে ফেলেছে তখন। বিসর্জনের সময় আর ভ্যান ছিল না। বাড়ির ঠিক পাশেই আর প্যান্ডেল হত না। মণ্ডপেও তেমন বসে থাকার আনন্দ ছিল না। বসলেই কিছুক্ষণের মধ্যেই নাম আর স্কুল জানতে চাইত পাশের জন। নাম শুনেই যেন দুরত্ব তৈরি করে ফেলত বাকিরা। একা হয়ে যেতাম খুব। তবুও অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দেওয়ার একটা দুর্নিবার টান ছিল। ধীরে ধীরে সেই পরিসরও ছোটো হতে থাকল। কিন্তু বেঁচে থাকল মহালয়া। এটা কেউ কেড়ে নিতে পারল না। এখনও বিশ্বাস করি, আমি যা মানতে পারি সেটাই আমার ধর্ম। আমার পুজো। ভক্তির কাছে এক বার নয়, বার বার মাথা নোয়াতে আমার সত্তা আমায় বাধা দেয় না। কেননা এই মাটিতেই জন্ম আমার। এখানকার সব উৎসবও সমান ভাবে আমার। মাতৃভূমির চেয়ে বড় দেবতা কিছুই নেই। মা দুর্গার যে মন্ত্রটুকু আমার মুখস্থ সেটাও আমার শিক্ষা ও বেড়ে ওঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এটাও আমার অস্তিত্বের অংশ।
বদলে গিয়েছে আরও অনেক কিছু। এখন মণ্ডপে নয়। সারাদিন পথেই দুর্গাদের দেখা মেলে। মনে মনে সেই মুখস্থ করা ‘রূপং দেহি, জয়ং দেহি’ বিড়বিড় করেও মনে হয়, রূপ তো বদলায় কিন্তু জয় কি সহজ? ধান বিক্রি করে নিজের রক্ত পরীক্ষা করতে আসা জলঙ্গির পদ্মাপাড়ের পাপড়ি মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) যখন বলেন, ‘‘আমরা তো গরিব! আমরা কি আর রোগ সারিয়ে বাঁচতে পারি? স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে এই টাকাটা আজ পেলাম। মেয়েমানুষের অসুখে কে বার বার টাকা দেবে বলুন তো!’’ তখন পৃথিবীটা খুব ছোট হয়ে আসে। মনে হয়, জয় মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী বছরে এক বার বলে কি আর বিপদ টলে? বিপদ তো প্রতি মুহূর্তের। পাপড়ির মা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন। পাপড়িও হয়তো দিন গুনছেন। এখনও সহ্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু যে দিন আর সইবে না?
এই দুর্গাদের বিসর্জনের তাই নির্দিষ্ট কোনও তিথি নেই। মহালয়ার ভোর যে ‘জাগো, দুর্গা’ বলে ঘুম ভাঙাত সেই ভাবে কি আমরা সত্যিই জেগে উঠতে পারলাম? যে কালো মেয়েটিকে জন্মের পরে আছড়ে মারল বাবা, সেই কন্যাহন্তারক পিতা কি কখনও জেগে উঠবেন? দরজায় ‘সরি আম্মা’ লিখে হোমে আশ্রয় নেওয়া অত্যাচারের শিকার মেয়েটিও অশুভ শক্তির প্রতিবাদে ছাড়ে ঘর। সেই পরিবারও কি জেগে উঠবে?
এক সময় ভাবতাম, বিসর্জনের পরে মা দুগ্গা জলপথে শ্বশুরবাড়ি যান। এখন বুঝতে পারি, বহু মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির নামে আসলে জলেই ফেলে দেওয়া হয়। বহরমপুরের রিনা সরকার (নাম পরিবর্তিত) ২২ বছরে স্বামীকে হারান। এক মেয়েকে নিয়ে চলছে না সংসার। স্বামী লটারির টিকিট বিক্রি করতেন। নিরুপায় রিনা শ্বশুরবাড়িতেই থাকেন। দু’বেলা, দু’মুঠো খাবার জোটে সেখানে। রিনা নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটা বিজ্ঞাপন দেন কাজের। সেই বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে যায় তাঁর দেওরের। শাশুড়ি রিনা ও তাঁর মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। বলেন, ‘‘আমরা কি খেতে দিচ্ছি না! লোকের কাছে কাজ চেয়ে আমাদের অপমান করার সাহস তুমি পেলে কী করে?’’
অসহায় রিনা ফোন করেন, ‘‘দিদি, ওরা আমায় বের করে দিল! এখন কোথায় যাব?” এত বড় পৃথিবী নিমেষে তেপান্তরের মাঠ হয়ে যায়! মৃত্যুর জন্য কয়েক হাত জায়গার দরকার হয়। তা হলে বেঁচে থাকার জন্য কতটা? ছোটবেলার প্রতিমা বিসর্জনের সেই ক্লান্তি এখনও পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায়। মনে হয়, বছরের সব দিনই বুঝি কোনও না কোনও মেয়ের বিসর্জনের দিন।
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy