Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
সীমান্তদ্বন্দ্বের লাভক্ষতি
India

ক্ষমতাদখলের লড়াই ঠেকাবে, অতিমারিরও সেই সাধ্য নেই

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সার্বিক ভাবে গুণগত দিক দিয়ে অপরিবর্তিত থাকে।

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২০ ০০:৪১
Share: Save:

লাদাখ সীমান্তে ভারত ও চিনের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে এক উদ্বেগজনক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সমস্ত পৃথিবী যখন অতিমারির দাপটে বিপর্যস্ত, তখন এই আন্তর্দেশীয় দ্বন্দ্বের পরিমণ্ডল কেন মাথাচাড়া দিচ্ছে? আসলে, অতিমারি বিশ্ব রাজনীতির কোনও মৌলিক পরিবর্তন করেনি। উল্টে প্রথাগত ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে তীব্রতর করেছে। এক দিকে যখন এই অদৃশ্য শত্রু সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বের ভিত নড়িয়ে দিয়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে বেহাল করে তুলেছে, এই অস্থির পরিস্থিতিকেই কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়েছে বিশ্বের প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। এই পরিপ্রেক্ষিতে, আমাদের আজকের ভারত-চিন সম্পর্কের অবনতিকে বিচার করতে হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সার্বিক ভাবে গুণগত দিক দিয়ে অপরিবর্তিত থাকে। ক্ষমতা এখানে বিকেন্দ্রিত, এখানে সার্বভৌম শক্তি নেই, রাষ্ট্র স্বাধীন, আর জাতীয় স্বার্থ দেখাটাই অনিবার্য। শুধু, কার হাতে কতখানি ক্ষমতা, সেটা যুগে যুগে বদলায়। জাতি-রাষ্ট্রগুলি তৈরি হওয়ার পর প্রায় সব সময়েই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে দুনিয়ার কোনও একটা ‘হেজেমনিক’ বা সর্ব-আধিপত্যবাদী শক্তি। সেই শক্তিই থেকেছে সামগ্রিক পৃথিবীর নিয়ম-নির্ধারক হয়ে, সে-ই অন্যান্য দেশের প্রাপ্য সুযোগসুবিধা নির্ণয় করেছে। এই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র কিন্তু কালের নিয়মে দুর্বল হয়, তার প্রতিপক্ষ শক্তি তার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকে। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের ইতিহাসে এর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি।

অবশ্য যতই ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ-সমৃদ্ধ হোক, এই ঘটনাকে ঠিক অনিবার্য বলা যায় না। ১৯৪৫-এর পর থেকে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠল, ১৯৯০-এর বিপুল পরিবর্তনের পরও তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েনি। বিশ্ব অর্থনীতির মূল প্রতিষ্ঠানগুলি, আন্তর্জাতিক আইনের পরিভাষা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিস্তার ও গুরুত্ব, সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবির অগ্রাধিকার, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের নিয়মাবলি ও শক্তি ভারসাম্যের মূল গতি-প্রকৃতি মোটের উপর একই থেকে গেছে। কিন্তু, গত এক দশকে চিনের উত্থান বিশেষ ভাবে চোখে পড়ার মতো। এর পাশাপাশি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমশ শক্তিক্ষয় ও প্রভাবহ্রাসও লক্ষণীয়। পারমাণবিক অস্ত্রে নির্মিত ভীতির ভারসাম্যে বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি না হলেও, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার রূপান্তরের প্রক্রিয়া থেমে থাকতে পারে না। এই প্রক্রিয়া এখন অতিসক্রিয়। পৃথিবীর নানা প্রান্তে আমেরিকা ও চিনের স্বার্থের সংঘাত ঘটছে এবং তা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। প্রথাগত ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতবাদে বিশ্বাসী দুই রাষ্ট্র এই ছক ছেড়ে বেরোতে পারছে না।

সহযোগিতার ক্ষেত্র যে একেবারে নেই, তা নয়। কিন্তু, মুশকিলের ব্যাপার, চিনের রাষ্ট্রপ্রধান শি চিনফিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুধু ধ্রুপদী ভূ-রাজনৈতিক ধারণায় বিশ্বাসী নন— তাঁরা উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ব্যক্তি-সর্বস্ব রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক। তাই সঙ্কটের রাজনীতি ঘনীভূত করতে তাঁরা একটুও পিছপা নন। বিশ্ব-রাজনীতির পারদ যত চড়ে, তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তত সাধিত হয়, গ্রহণযোগ্যতা যেন আরও বাড়ে। কেউ কাউকে জমি ছাড়তে নারাজ। অতিমারির এই সার্বিক বিশ্ব-সঙ্কটের মুহূর্তেও মার্কিন-চিন সহযোগিতার পরিবর্তে তীব্র মতানৈক্য ও সংঘাত ক্রমশ বাড়ছে। কোভিড-১৯’কে কেন্দ্র করে একে অপরকে দোষারোপের মেঠো রাজনীতিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। দু’দেশের আচরণেই অনুতাপের চিহ্নমাত্র নেই।

ভারত ও চিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নতুন করে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে সামগ্রিক ভাবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি খারাপ হয়েছে। পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অস্বস্তি বেড়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাচ্ছে না, বরং কয়েক মাস আগে নাগরিকত্ব নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিবাদ তাকেও বিরক্ত করেছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই চিন-ভারত সম্পর্ককেও বুঝতে হবে। আমাদের অঞ্চলে চিনের উপস্থিতি ও প্রভাবের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে, এবং ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক আরও জটিল রূপ নিচ্ছে। ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি চিনের দক্ষিণ এশিয়া-নীতিকে প্রভাবিত করছে। ভারত পাকিস্তানের উপর যত চাপ বাড়াচ্ছে, চিনও ভারতের সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি ও সীমান্তরেখা লঙ্ঘনের মধ্যে দিয়ে তা প্রতিহত করছে। মোদী ও ট্রাম্পের সখ্য চিনকে ভাবাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বিশ্ব-বাণিজ্যের পুনঃস্থাপন, প্রায় সব বিষয়েই ভারত ও চিনের দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের বহুমুখী প্রতিযোগিতা যত বাড়ছে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনবহুল দুই দেশের সম্পর্কের ঝোঁক ততই নিম্নমুখী।

বাস্তববাদী বিশেষজ্ঞ বলবেন, এটা অনিবার্য। উদারনৈতিক বিশ্বনির্মাণ পরিকল্পনা যে হেতু এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে, কার্যকারিতার যুক্তিতে শান্তি নির্মাণের সম্ভাবনাও ততই উধাও হয়েছে। চিনের কথা ছেড়ে দিন। ট্রাম্পের বিশ্বায়ন-বিরোধী সংরক্ষণনীতি এত দিনে উদারনীতির কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছে। আর, ২০২১-এর মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা জয়ী না হলে, আদর্শগত ভাবে মার্কিন বিদেশনীতির কোনও পরিবর্তন হবে না। যদিও বা ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতা পায়, মনে হয় না চিনের অতি-জাতীয়তাবাদী নাছোড় মনোভাব আমেরিকাকে দ্রুত চিন্তামুক্ত হতে দেবে। ভারতও বিশ্ব ভূ-রাজনীতির এই ছকেই বাঁধা। ঐতিহাসিক ব্যবধান, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও আদর্শগত বিভেদ ছাড়াও, এই নকশা কিন্তু একক ভাবে কোনও দেশ পরিবর্তন করতে পারে না।

দুটো কথা বলতে চাই। প্রথমত, ভারত ও চিনের রাজনীতিতে যে জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রাবল্য, প্রতিটি সংঘাতই কিন্তু সেই রাষ্ট্র-সংস্কৃতিকেই শক্তিশালী করবে। শি চিনফিং ও মোদী তাই এই সঙ্কটগুলিকে ব্যবহার করবেন তাঁদের জনপ্রিয়তার স্বার্থে। এটা নিশ্চিত ভাবে একটা ঝুঁকিপূর্ণ নীতি। এখন, ঘটনা হল, জাতীয়তাবাদের মোড়কে যদি বহু-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে পেশ করা হয়, তা নাগরিকের জাতীয়তাবাদী স্পৃহাকে মজবুত করে, দেশের প্রধান নেতার প্রতি বিশ্বাস ও সমর্থনকে আরও মজবুত করে, এবং চরম হতাশার মধ্যেও দেশবাসীকে খানিক উদ্দীপ্ত করে। স্বভাবতই এই নীতির সাফল্য নির্ভর করে নিয়ন্ত্রিত সামরিক সঞ্চালন ও কূটনীতির মধ্যে যতটা সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করা যায়, তার উপর। কিন্তু যদি তা না রাখা হয়, যদি নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়, সে ক্ষেত্রে সঙ্কটের সম্ভাবনা প্রবল। আজকের এই বিপর্যয়ের দিনে, দু’দেশের সামনে যে বিশাল সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ, তার পরিপ্রেক্ষিতে সেই সংঘাতের বাতাবরণ কিন্তু দেশের নেতৃত্বের রাজনৈতিক বৈধতার প্রশ্নটাকে আড়াল করতে সক্ষম।

দ্বিতীয়ত, দেখা যাচ্ছে করোনা-সঙ্কট রাজনীতিতে রাষ্ট্রশক্তির হাতকেই শক্তিশালী করছে। মানুষের রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। কিন্তু রাষ্ট্র যত শক্তিশালী হবে, নাগরিক জীবনে তার নিয়ন্ত্রণের মাত্রা তত বাড়বে। শক্তি-নির্ভর রাষ্ট্র এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে প্রস্তুত। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় নিয়োজিত ও প্রাচীন সভ্যতার গরিমায় বলীয়ান চিন ও ভারত ভূ-রাজনীতির এই চৌম্বক আকর্ষণ থেকে নিজেদের বিরত রাখবে, তা ভাবার কোনও কারণ নেই।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

India China LAC COVID-19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy