আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কি গরমের ছুটিতে বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন সাইট থেকে শ্রমিকদের পঞ্জিভুক্ত করতে পারবে? নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য ৯০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছে, কিন্তু তাঁরা কোনও সুবিধে পাচ্ছেন না।” অকপট স্বীকারোক্তি কর্নাটকের শ্রম কমিশনারের। সেটা ছিল ২০১৮ সাল। ১৯৯৬ সালে আইন হয়েছিল, নির্মাণ সংস্থাগুলি রাজ্য সরকারকে ১-২% সেস দেবে, সেই টাকা জমা হবে নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পরিষদে। ওই টাকায় হবে শ্রমিকদের ক্যান্টিন, হস্টেল, বিমা, স্বাস্থ্যপরীক্ষা, বেতন-সহ মাতৃত্বের ছুটি।
সব রাজ্য মিলিয়ে সেস বাবদ নির্মাণ শ্রমিক তহবিলে জমা পড়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। ১৯৯৬ সালে তহবিল শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সাকুল্যে ২২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। দেশের পাঁচ কোটিরও বেশি নির্মাণ শ্রমিক, তাঁদের অর্ধেকেরও নাম নথিভুক্ত হয়নি। অতিমারি, লকডাউনের চরম দুর্দশাতে মাত্র পাঁচ হাজার কোটি টাকা পেয়েছেন ১ কোটি ৮৩ লক্ষ শ্রমিক।
নির্মাণ শ্রমিক ছাড়া আরও ৩০-৩২ কোটি অসংগঠিত শ্রমিক আছেন। তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য ২০১০ সালে তৈরি হয়েছিল একটি কেন্দ্রীয় তহবিল, হাজার কোটি টাকা দিয়ে। প্রতি বছর ৫০০-৬০০ কোটি টাকা করে ওই তহবিলে দেওয়া হত। ২০১৬-২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থা (সিএজি) দেখতে পায় যে, অব্যবহৃত মোট ১৯২৭ কোটি টাকা রাজকোষে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষার খাত বাজেট থেকে তুলেই দেওয়া হয়েছে। কেন, তার ব্যাখ্যা চেয়েও পাননি অডিট কর্তারা।
খনি শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য খনি থেকে পাওয়া রাজস্বের একাংশ জেলা খনিজ তহবিলে জমা হয়। তত্ত্বাবধানে থাকেন জেলাশাসক। ওই তহবিলের থেকে খনি এলাকার অধিবাসীদের জন্য পানীয় জল, রাস্তা, ঘরবাড়ি, স্বাস্থ্য পরিষেবা, ইত্যাদির ব্যবস্থায় খরচ হওয়ার কথা। দেশে ২৮৭টি জেলায় খনি আছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে, মোট ৪৬,০০০ কোটি টাকা জমা হয়েছে, কিন্তু ব্যবহার হয়নি ৫৩%। পশ্চিমবঙ্গে জমা পড়েছে ৫৬ কোটি টাকা, ৭৭% অব্যবহৃত।
কেন টাকা পড়ে থাকে? একটা কারণ অবশ্যই শ্রেণিগত— শ্রমিকের প্রতি অবহেলা মধ্যবিত্ত আধিকারিকদের মজ্জাগত। কিন্তু আর একটা প্রশ্নও করা চাই। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা কি অসংগঠিত শ্রমিকের পরিষেবা দিতে পারে? রাষ্ট্র মানুষের পরিচিতি নির্দিষ্ট করে তার বাসস্থান দিয়ে— বুথ-ভিত্তিক ভোটদান, বসবাস-ভিত্তিক জমির দলিল, ঠিকানা-ভিত্তিক রেশন কার্ড, পঞ্চায়েত-ভিত্তিক জব কার্ড। সরকার যেন ধরেই নেয়, আমাদের বাঁচা-মরা একই জায়গায়। বাস্তব বদলে গিয়েছে। কেউ কাজের সূত্রে সপ্তাহে পাঁচ দিন শহরে থাকেন, কেউ বছরে চার-পাঁচ বার অন্য জেলায় বা অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান, কেউ বিভিন্ন বছর বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে যান, কয়েক মাস বা কয়েক বছরের মেয়াদে। কাজের স্থান, বেতন দেওয়ার মালিক, কাজের শর্ত, দূরত্ব, কাজের মেয়াদ, কোনওটাই এখন আর নিশ্চিত নয়, স্থায়ীও নয়।
নির্মাণ শ্রমিকদের ৫০ ভাগের বেশি পরিযায়ী শ্রমিক। ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ চালু হয়নি। গত বছর লকডাউন হতে দেখা গেল, প্রায় ২৫ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে দু’বেলা খাবার সরবরাহ করতে হচ্ছে। নগর প্রশাসনের কাছে খাতায়-কলমে এঁরা ছিলেন অস্তিত্বহীন। বাংলার শ্রমিক বেঙ্গালুরুতে বড় বড় নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেন, কর্নাটকের জিডিপি বাড়ান, কিন্তু সেখানে রেশন পান না।
শ্রমিকদের ৯০% আজ অসংগঠিত, ক্রমশ এঁরা স্থানীয় শ্রমিক থেকে ভ্রাম্যমাণ ও সর্বভারতীয় শ্রমিক হয়ে উঠছেন। তাই শুধু তাঁদের নামে তহবিল করলেই হবে না, তাঁদের পঞ্জিকরণ, রেশন, পেনশন, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যপরীক্ষা, মাতৃত্ব, সন্তানের শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদির প্রতিষ্ঠানগত ব্যবস্থা নিয়েও নতুন ভাবনার প্রয়োজন আছে।
প্রথমেই চাই রেশন কার্ডের দেশব্যাপী ব্যবহার। এর জন্য পুরপ্রশাসনের ওয়ার্ড দফতর এবং রেশন পরিকাঠামোর মধ্যে সমন্বয় চাই। তেমনই, নির্মাণকাজ যেখানে হচ্ছে, পুরসভার সেই ওয়ার্ডে নির্মাণ কর্মীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা, রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব। প্রায় ৩৮ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকের ৪৫ ভাগ স্বনিযুক্ত। পুর কর্তৃপক্ষ এঁদের স্বনিযুক্ত শ্রমিকের পরিচয়পত্র দিতে পারে। রাজ্যের দেওয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স যদি সারা দেশে গণ্য হতে পারে, পুরসভার পরিচয়পত্র বৈধ হবে না কেন? তা দেখিয়ে যে কোনও শহরে শ্রমিক রেশন, ভাতা বা বিমা পাবেন না কেন? বড় শহরগুলোতে লক্ষাধিক গৃহকর্মী কাজ করেন। প্রতি পাড়ায়, বড় হাউসিংয়ে পুরসভা ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে বহুমুখী পরিষেবা কেন্দ্র তৈরি করা যায়।
বর্তমানের সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা মানে ইট-কাঠের অফিস ঘর, টেবিল, ফাইল, কম্পিউটার। মানুষের সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠানগুলি— গ্রাম পঞ্চায়েত, পুরসভার ওয়ার্ড কমিটি— প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে দুর্বল। প্রশাসনিক ব্যবস্থা উপর-নীচ কাঠামোয় তৈরি। নানা বিভাগের সমস্তরের কর্মীদের মধ্যে সংযোগ-সমন্বয় কাঠামো তৈরি হয়নি। এক গ্রাম পঞ্চায়েত তার পাশের পঞ্চায়েতকে ৫ টাকাও পাঠাতে পারে না, রাজধানী ঘুরে সে টাকা যায়। সে কারণেই এক পঞ্চায়েতে ১০০ দিনের কাজের টাকা খরচ হয়ে কাজ বন্ধ হয়ে যায়, আর পাশের পঞ্চায়েতে কাজ করার লোক নেই বলে টাকা পড়ে থাকে। এই ধরনের অনমনীয়, অফিস-কেন্দ্রিক, ফাইল-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান অসংগঠিত শ্রমিকদের পরিষেবা দেবে কী করে? আজকের বাস্তবের সঙ্গে সাবেক ব্যবস্থা বড়ই বেমানান।
আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy