বিপুলসংখ্যক ভোট টানার যন্ত্র হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর উপর তাঁর দলের নির্ভরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। —ফাইল চিত্র।
ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বসলে দেখা যায়এ দেশের ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় বেশ নিশ্চিত হয়ে উঠছে। প্রথমটি এক সমস্যাদীর্ণ বিশ্ব অর্থনীতির পরিমণ্ডলে তার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসা। এবং দ্বিতীয়টি আগামী নির্বাচনগুলিতে জয়ের নিশ্চয়তা লাভ করে ভারতীয় জনতা পার্টির ক্ষমতা আরও বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়া। আর যদি নির্বাচনে জয়ের নিশ্চয়তা না-ও থাকে, তবে ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখা।
দ্বিতীয় বিষয়টির ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক ভোট টানার যন্ত্র হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর উপর তাঁর দলের নির্ভরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রসঙ্গত, এমন অবস্থা ভারতের ইতিহাসে কেবল ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছিল। এর পাশাপাশি নির্বাচন-ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দক্ষ বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপরেও দলের নির্ভরতা বাড়ছে।
কখনও কখনও কোনও ‘নিশ্চিত বিষয়’-এর আসল চেহারা প্রকাশ্যে এলে মোহভঙ্গ ঘটে যায়। যেমন চিনে শি জিনপিং আর ইরানে আয়াতোল্লাদের ব্যাপারে ঘটেছে। অক্টোবর মাসেই চিনের কমিউনিস্ট পার্টির বাহুবলী জিনপিংকে ন্যাশনাল পিপল্স কংগ্রেসে চিনের আলোচ্য বিষয়গুলি এবং সে দেশের নীতি-নির্ধারকদের প্রভাবিত করতে যা যা করা সম্ভব, সবই করতে হয়েছিল। জিনজিয়াংয়ের দূরপ্রান্তে এক অগ্নিকাণ্ডে জনা বারো ব্যক্তির মৃত্যুর অভিঘাতে চিনে ব্যাপক প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়। একদলীয় ব্যবস্থার রাষ্ট্র হিসেবে চিনের তরফে সর্বময় কর্তৃত্ব এবং বিরাট নজরদারি আশা করাই স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষণীয়, প্রতিবাদীদের একাংশ জিনপিংয়ের পদত্যাগ দাবি করে। ইরানে একই ভাবে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠিত আয়াতোল্লার শাসন পুলিশ হেফাজতে এক মহিলার মৃত্যুর প্রতিবাদে গর্জে-ওঠা এক আন্দোলনে কাঁপতে শুরু করেছে।
ভারতের ক্ষেত্রে নতুন নাগরিকত্ব আইন আর কৃষির বাজারীকরণের বিরুদ্ধে যে রাতারাতি এবং একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবাদ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, তার মাত্রায় খানিক পার্থক্য ছিল— এইটুকুই যা। দু’টি ক্ষেত্রেই মোদী সরকার কৌশলগত ভাবে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এই মুহূর্তে দেশে অন্য কিছু সমস্যা নিয়ে আন্দোলনের মেঘ ঘনিয়ে রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে ভাষানীতির কথা বলা যেতে পারে। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা টানাপড়েনের বিষয়টিকেও মাথায় রাখা দরকার। পাশাপাশি, কেন্দ্রের সঙ্গে অ-বিজেপি রাজ্য সরকারগুলির দ্বন্দ্বকেও মনে রাখতে হবে। একদা কেন্দ্রের দেওয়া ‘সহযোগিতামূলক কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক’বা ‘কোঅপারেটিভ ফেডেরালিজম’-এর প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে সেই সব রাজ্যের ক্ষোভের কথাও মনে রাখতে হবে।
এই সব দুর্ভাবনা কোনও ভাবেই মোদী সরকারকে তার স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে দমনের লক্ষ্য থেকে নিবৃত্ত করতে পারবে না। এক বন্ধুত্বপূর্ণ বণিকশক্তি তেমন কোনও বিরল কঠস্বরের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য লড়ে যাচ্ছে, কার্যত এক স্বাধীন টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে। যদি এই রাজত্ব তার হিন্দুত্বের নীতি সরকারের সমস্ত তন্তুগুলিতে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চালিয়ে যায় (ইতিহাস ‘পুনর্লিখন’-এর মতো প্রকল্প দিয়ে), এখনও পর্যন্ত অপরিবর্তিত সংবিধানের মূল কাঠামোর উপরে যদি হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে, তা হলে ভাবনার ব্যাপার থেকেই যাচ্ছে।
চিন বা ইরানের ঘটনাক্রম নিয়ে দুশ্চিন্তার অবসান তখনই ঘটবে, যখন জিনপিং তাঁর বিরোধী ঝোড়ো হাওয়াকে সামলে স্থির থাকতে পারবেন, যখন যাবতীয় নারীবাদী প্রতিবাদকে নস্যাৎ করে আয়াতোল্লারা টিকে যেতে পারবেন। এই সব দাম্ভিক, উদ্ধত সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসতে থাকা বিদ্রোহ-সম্ভাবনাগুলির অন্তর্নিহিত কারণ কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে উঠে আসা এই সব প্রতিবাদ আন্দোলনগুলির সম্ভাব্য কারণের থেকে চরিত্রগত ভাবে আলাদা (এবং সেখানেই বিপদ লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে হয়)। যখন সব কিছুই কারও মর্জিমাফিক হতে শুরু করে, তখন যে বিস্ময় বলতে কিছু থাকে না, সে কথা সমঝদার মানুষ জানেন।
সে দিক থেকে দেখলেঅর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনাগুলি সেই সময় বিনষ্ট হয়ে যেতে থাকে, যখন সব কিছুই বড় বেশি নিশ্চিত বলে মনে হতে শুরু করে। ইতিহাসের আঙিনা থেকে বিষয়টি দেখলে মনে হতে পারে, সেই সময় অর্থনীতি যেন তৈলাক্ত কিছুতে পা হড়কাচ্ছে অথবা নিতান্ত খরায় শুকিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত এমন ঘটনা শুরু হয় আচমকা বৃদ্ধির এক তরঙ্গ ও সেই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির প্যাঁচালো যাত্রা দিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে, এই সব চেনা ঝুঁকির বিপরীতে অর্থব্যবস্থাই এক ধরনের স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করে রেখেছিল। ঠিক তার পরেই অতিমারি শুরু হয় এবং তার তরঙ্গ মানুষের জীবনকে একবারে ওলটপালট করে দিয়ে যায়। শুধু মানুষী জীবন নয়, দু’বছরের স্থবির অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করে তুলেছিল সেই ঝঞ্ঝা। সেই বিপদ কাটিয়ে যখন ব্যবস্থা আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এবং দেশ দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে দেশ নিজের নজরকে থিতু করতে চাইছে, তখন অন্তর্নিহিত দুর্বলতাই উচ্চাশাগুলির গলা টিপে মেরে ফেলে— লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকারত্বে ডুবে যান। একটি বড় অংশের মানুষ প্রায় অবমানবের জীবন যাপন করতে বাধ্য হন।
এই সব মাথায় রেখেই আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে অগ্রধিকার দেওয়ার যে আশ্বাস অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন, তাকে স্বাগত জানাতেই হয়। বাস্তব পরিকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগের এই দ্বিগুণ গুরুত্ব অনেক দিন ধরেই কাঙ্ক্ষিত ছিল।গরিব মানুষকে সমাজের অন্য অংশের অনুকম্পা-নির্ভর হয়ে যাতে কাটাতে না হয়, তা নিয়ে বন্দোবস্তের প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। ভারতের গণস্বাস্থ্য পরিষেবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশ বিপর্যস্ত। যদি তা না হত, তবে অতিমারির প্রকোপ এ দেশে কম হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে গণশিক্ষা ব্যবস্থা থেকে স্কুল-পাশ বা স্নাতক উৎপন্ন হয়েই চলেছে, যারা প্রায়শই কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য উপযুক্ত নয়। যদি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে হতে থাকে, তবে এই দুই ক্ষেত্রের চেহারা বদলাবে নিশ্চিত। এ থেকে সমস্যার প্রতি এক নতুন সচেতনতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এর পরে যা বাকি থাকে, তা কর্মনিযুক্তির যোগ্য নয়, এমন অংশের মানুষের বেকারত্বের সমস্যা। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। বিশেষত, যুব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে তো বটেই। ক্রমবর্ধমান অসাম্যের মাঝখানে বিষয়টি যেন অযাচিত ভাবে এক সংক্রমণকে ডেকে আনার মতো ঝুঁকি বহন করে। সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত কার্ল মার্ক্স যাকে ‘জনতার আফিম’বলেছেন, সে দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে সমস্যার সমাধানের ভিন্নতর পথের সন্ধান করা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy