ভারতে নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের সিংহভাগই ঘটায় বাড়ির লোক। ফাইল চিত্র।
মেয়ে ক্লাসরুমে বসে নিজের হাত ক্ষতবিক্ষত করে। অভিভাবককে ডাকা হয়। মেয়ে নীরবে কাঁদে; মার চোখেও জল। দু’জনেই প্রত্যহ মার খান, অপমানিত হন। দিদিমণি ক্যালেন্ডারের দিকে তাকান। ২৫ নভেম্বর ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর এলিমিনেশন অব ভায়োলেন্স এগেনস্ট উইমেন’ (ছবিতে বেঙ্গালুরুতে দিনটি পালনের একটি দৃশ্য)। ওই দিন থেকে নাকি পরবর্তী ১৬ দিন পালিত হয় নারীর উপর হিংসা বন্ধের জন্য ‘সক্রিয়তা’র দিন হিসাবে। তবু এই অসহায় মা-মেয়ে প্রতিরোধ করতে পারেন না ঘরের আক্রমণকারীকে, পাশে পান না আর কাউকে।
আফতাব-শ্রদ্ধার কাহিনি এখন সকলের মুখে মুখে। কিন্তু এই সব প্রকাশ্য বীভৎসতার আড়ালে নারীর প্রতি এই দেশে ঘটে চলা প্রাত্যহিক অনাচারের অব্যক্ত কাহিনি আমাদের অজানা থেকে যায়। আর তেমন কাহিনিগুলি শুরু হয় সেই পর্ব থেকে, যখন এমনকি মেয়েটি জন্মাতেও পারেনি। ২০২১ সালের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট’ বলছে, সারা বিশ্বে লিঙ্গ নির্ধারণপূর্বক যে ভ্রূণহত্যা হয় তার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই হয় ভারত এবং চিনে। কন্যাশিশু জন্মালেও বিপরীত লিঙ্গের চেয়ে বেশি সংখ্যায় তারা মারা যায়। এই মৃত্যুর পিছনে যে অবহেলা, অপুষ্টি, অসুখ এবং চিকিৎসাহীনতা রয়েছে, তাও কি নির্যাতন নয়?
পঞ্চম শ্রেণির এক শিশু কিছুতেই স্কুল কামাই করে না। জ্বরে গা পুড়ে গেলেও না। তার হাতপায়ে রহস্যজনক আঁচড়ের দাগ। বাচ্চাটির কাছে বাড়ি যেন এক ভয়ের জায়গা। দিদিমণি মা’বাবাকে ডেকে পাঠান। তাঁরা নির্বিকার। শেষকালে জানা যায়, বাচ্চা থাকে তার দাদু-দিদার কাছে, আর দাদু ওই ছোট্ট নাতনির উপর নিয়মিত যৌন নির্যাতন চালান। বাড়ির সবাই জানেন, কিন্তু পাত্তা দেন না। থানাপুলিশ হয়, মেয়েটি হয়তো সাময়িক স্বস্তিও পায়। কিন্তু সে স্বস্তি কত দিনের?
এ সব কোনও নির্দিষ্ট ঘটনা নয়, অসংখ্য ঘটনার অন্যতম। এরা সরকারি পরিসংখ্যানে আসে না। কারণ ভারতে নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের সিংহভাগই ঘটায় বাড়ির লোক। নারী নির্যাতনের অর্ধেকও যদি নথিবদ্ধ হয়, সে সংখ্যাও বিস্ময়কর। এই শারীরিক, মানসিক অত্যাচার বা যৌন নির্যাতন কোভিডের পর আরও অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া পথঘাটের অপমান, অত্যাচার, খুনখারাপি, পণের জন্য পৈশাচিকতা ইত্যাদি তো আছেই।
১৪৬টি দেশের মধ্যে লিঙ্গবৈষম্যের বিশ্বতালিকায় ভারত এখন ১৩৫ নম্বরে। ২০২১ থেকে নাকি ২০২২-এ খানিক উন্নতি হয়েছে, তবে তা এতই সূক্ষ্ম যে, দশমিকেরও দু’ঘর পিছনে লজ্জায় লুকিয়ে থাকে। আর তালিকার বাইরে পড়ে থাকে সেই অগুনতি ‘ছোটখাটো’ নির্যাতন, বহু যুগের ‘অভ্যাস’ যাদের ‘স্বাভাবিক’ বানিয়ে ছেড়েছে। অধিকাংশ পরিবারেই মাছের বড় টুকরো, ফল বা দুধের ভাগ, গাড়ির সামনের আসন, এমনকি শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ পর্যন্ত প্রথমে পুরুষেরই প্রাপ্য।
নারী নির্যাতনের প্রতিকার কোথায়? ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’তে? আদালতে ‘গার্হস্থ হিংসা’র কেস অমীমাংসিত ঝুলছে ৪ লক্ষের বেশি। ধর্ষক জামিন পেয়ে বাইরে বেরিয়ে একই নারীকে পুনর্বার ধর্ষণ করছে, তাকে বা তার আত্মীয়-পরিজনকে খুন করছে। ২০২০ সালে ভারতে ধর্ষকদের সাজা হয়েছে মাত্র ২৭ শতাংশ। পরের বছর ‘গার্হস্থ হিংসা’য় অভিযুক্তদের শাস্তি হয়েছে মাত্র ২৪ শতাংশ। অভিযোগ জানাতেই পারেনি, এমন দুর্ভাগার সংখ্যা তো গুনে শেষ করা যাবে না।
নারী শিক্ষার উন্নতি হলে, বা মেয়েদের কর্মসংস্থান হলে, এ দেশে নারী নির্যাতন কমবে, এ কথা হলফ করে বলার সাহসও এখন আর নেই। ভারতে ১০০ জনে ৩০ জনের বেশি নারী আজও নিরক্ষর। বিভিন্ন ‘শ্রী’যুক্ত প্রকল্পের আকর্ষণে মেয়েরা হয়তো স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, কিন্তু মাত্র ৪১ শতাংশ ছাত্রীই ১০ বছর স্কুলে টিকে থাকতে পারছে। কোভিডের কোপ যে কত ছাত্রীকে স্কুলছাড়া করেছে, তার হিসাব কষা মুশকিল। ভারতের সমগ্র শ্রমশক্তিতে মেয়েদের যোগদান এখনও ২০ শতাংশই ছুঁতে পারেনি (তাও বেশির ভাগটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রে যেখানে বেতনবৈষম্য প্রকট)। কোভিড তো দানবিক গতিতে মেয়েদের কর্মহীন করেছে।
দিদিমণির সঙ্গে একই ট্রেনে যাতায়াত করেন সস্তা সিন্থেটিক পরা ‘তমুকদি’। মধ্যযৌবনা সেই দিদি প্রাইভেট ফার্মে কাজ করেন। অফিস বদলালেন যখন, কারণ জিজ্ঞেস করায় যন্ত্রণাকাতর ঠোঁট চেপে বললেন, “আসলে বেশি দিন পারা যায় না।” কী পারা যায় না, সে প্রশ্ন সহজ এবং উত্তরও জানা।
কাগজ পড়তে পড়তে দিদিমণি তাঁর চার পাশের মেয়েদের কথা ভাবেন। এ দেশের আইনসভায় আইন প্রণয়নের জন্য আমরা এখনও ১৫ শতাংশ নারীকেও পাঠাতে পারিনি। অবশ্য আইনসভায় মহিলার সংখ্যায় বাড়লেই যে মেয়েরা নিরাপদ হবেন, এমন নিশ্চয়তাও নেই। নারী নির্যাতনের অভিযোগ আছে, এমন ব্যক্তিও সহজেই ভোটে দাঁড়াতে পারেন, জিততেও পারেন অক্লেশে। আমাদেরই ভোটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy