আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস নিজের প্রস্তাবিত অর্থনীতির রূপরেখাকে বলেছেন ‘অপরচুনিটি ইকনমিক্স’ বা ‘সুযোগের অর্থনীতি’। একে অবশ্য ‘কমলার ভান্ডার’ও বলা যায়। সেখানে মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধের কথা আছে, আছে ওষুধের দামের ঊর্ধ্বসীমার কথা, গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সুবিধাদায়ী ব্যবসাকে করে সাশ্রয় দেওয়ার কথা। আর আছে অতিধনীদের কর বাড়ানোর দুঃসাহসী প্রস্তাব। এবং পুরোটাই যেন অনুদানের রাজনীতির মোড়কে পোরা।
অনুদান! আমেরিকার ভোটের বাজারে! যেমন, প্রথম বার বাড়ি কেনার জন্য আমেরিকানদের চার বছরের মধ্যে ২৫,০০০ ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন হ্যারিস। ২০২১-এ বাইডেন তাঁর প্রস্তাবিত আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যানের অঙ্গ হিসাবে ঘোষণা করেন চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট। তার পাশাপাশি, শিশুর জন্মের প্রথম বছরে পরিবারকে অতিরিক্ত ৬,০০০ ডলার কর ছাড় দিতে চাইছেন কমলা। হ্যারিসের আর্থিক প্রতিশ্রুতির লক্ষ্য প্রধানত শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্তরা, বিশেষত যে সব তরুণ উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাননি, তাঁরা। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গরা, হিসপ্যানিকরা। তাঁরাই প্রধানত ডেমোক্র্যাটদের ভোটব্যাঙ্ক। তাই ভোটের মুখে হ্যারিসের প্রস্তাবনা যে সুনির্দিষ্ট ভাবে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ককে সন্তুষ্ট করতেই, সে বিষয়ে সন্দেহ কম।
কিন্তু লক্ষ্মীর ভান্ডার হোক বা কমলার ভান্ডার, তা কি সত্যিই ম্যাজিক দেখাতে পারে— সমাজের উত্তরণে, বা ভোট-বাক্সে? প্রশাসক-রাজনীতিকরা তেমনটাই ভাবছেন নিশ্চয়ই। যিনি কমলার ভান্ডার নিয়ে হাজির, তিনিও ভাবছেন; আর যিনি তার মধ্যে অশনিসঙ্কেত দেখছেন, ভাবছেন তিনিও। এই যেমন, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে শুরু হলেও অন্য কিছু রাজ্য আইডিয়াটা লুফে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। আজকের অতিমারি-উত্তর দুনিয়ায় প্রবল মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান অসাম্য, তীব্র বেকারত্ব, সব মিলিয়ে প্রবলতর অর্থনৈতিক দুর্দশা, এবং সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এলোমেলো ডানা ঝাপটানির ফলে তৈরি হওয়া কর্মক্ষেত্রে তীব্র নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ক্রমশ বদলাতে থাকা এক জটিল সামাজিক প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালেই রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বিশ্বজনতার জন্য চেয়েছিলেন একটি শক্তিশালী নিরাপত্তার জাল। সে হয়তো কোনও কল্পিত ‘অন্নপূর্ণার ভান্ডার’। বাস্তবের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ বা ‘কমলার ভান্ডার’গুলো হয়তো সেই সার্বিক নিরাপত্তার জালের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ মাত্র।
এমনিতে রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের বিনামূল্যে পণ্য বা পরিষেবা প্রদানের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ, রোমান প্রজাতন্ত্রের পতনের পর, রোমের শাসনক্ষমতায় ছিলেন এক স্বৈরাচারী শাসক। সে সময় সাধারণ জনতার দুর্দশা বাড়ে, ক্ষুধা প্রকট হয়, অভাব দেখা দেয় এমনকি প্রাথমিক নিকাশি ব্যবস্থারও। দাঙ্গা শুরু হয় সরকারের বিরুদ্ধে। উদ্ধারের পথ হিসাবে তৎকালীন রোমান সরকার নাগরিকদের বিনামূল্যে খাদ্যশস্য, রুটি, মাংস ইত্যাদি বিতরণের ব্যবস্থা করে। সঙ্গে আয়োজন করে রাস্তায় কুচকাওয়াজ, উৎসব, রথ-দৌড়, পশুর লড়াই, ইত্যাদি নানাবিধ বিনোদনের। বিনি পয়সায় ভোজ আর বিনামূল্যে বিনোদনের জোগান পেয়ে সন্তুষ্ট হয় মানুষ।
ভারত থেকে ফিনল্যান্ড, আমেরিকা থেকে ব্রাজ়িল, কানাডা থেকে স্পেন, মেক্সিকো থেকে নামিবিয়া, কোনও দেশের রাজনীতিতেই আজ নাগরিকদের নগদ অথবা বিনামূল্যে পণ্য বা পরিষেবা প্রদানের বিষয়টাকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব— রাজনীতির রংধনুর যে প্রান্তেই অবস্থান করুন না কেন, বিষয়টির গুরুত্ব মানতেই হবে। তবে রাষ্ট্রের সম্পদ সর্বদাই সীমিত। তাই বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিকদের পরামর্শ নিয়ে, ডেটা-সমুদ্রের যথাযথ অমৃতমন্থন করে সংশ্লিষ্ট সমাজের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার নিরিখে এই সব সামাজিক পুনর্বণ্টনের প্রকল্পগুলি চালু করাই বোধকরি অভিপ্রেত।
তর্ক তবু জারি থাকে। এই খয়রাতি কি নেহাতই নির্বাচনী যুদ্ধের হাতিয়ার? না কি তার ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর নাগরিক পরিষেবার সর্বোত্তম মাধ্যম হয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে সমাজের অসাম্য-ক্ষুধা-বেকারত্ব-দারিদ্র নির্মূল করার দিকে তা একপা হলেও এগোয়? আসলে রাজনৈতিক প্রয়োজনে খয়রাতির প্রতিশ্রুতি আর সামাজিক কল্যাণে, সামাজিক সুবিচারের প্রয়োজনে রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থ কিংবা পণ্য বা পরিষেবা বিতরণের মধ্যে রয়েছে এক সূক্ষ্ম পার্থক্য। দু’ক্ষেত্রেই যদিও ঘোষণাটা আসে রাজনীতিবিদ-প্রশাসকের কাছ থেকে, এবং দু’ক্ষেত্রেই সামাজিক ন্যায়সাধনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জুড়ে থাকে তার রাজনৈতিক প্রভাব। এই দুই উদ্দেশ্যের সীমারেখা আবছায়ায় মোড়া। অস্পষ্ট, ধূসর। যে ধূসর সীমান্ত ক্রমেই চওড়া হতে থাকে যে কোনও পলিটিক্যাল সোসাইটিতে। যে কোনও সমাজেই বিনি পয়সায় ভোজ প্রদানের মূল কারণ বুঝতে তাই হিমশিম খায় জনগণ।
‘কমলার ভান্ডার’ কতটা অতিরিক্ত ভোট টানতে পারবে আমেরিকার নির্বাচনে, সুনির্দিষ্ট সমীক্ষা ব্যতিরেকে তা বলা অসম্ভব। তবে, হ্যারিসের অর্থনৈতিক প্রস্তাবনার বেশির ভাগেরই রূপায়ণের জন্য প্রয়োজন আমেরিকান কংগ্রেসের সবুজ সঙ্কেত। আজকের দ্বিধাবিভক্ত আমেরিকান সমাজে কংগ্রেসের বিন্যাস যা হতে চলেছে, তাতে এই অনুমোদন পাওয়া হয়তো অসম্ভব। ডেমোক্র্যাট দল তা বিলক্ষণ জানে। রিপাবলিকানরাও জানেন যে, কমলার ভান্ডার অনেকটাই থাকবে অধরা। তবে ভোটের বাজারে তো রূপায়ণ নয়, এই ঘোষণার অভিঘাতটাই মুখ্য।
কিন্তু, এই যে শুধু উন্নয়নশীল দুনিয়ায় নয়, উন্নত বিশ্বের সদর দফতরেও রাজনীতিকরা মনে করছেন যে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অর্থনৈতিক সহায়তা জনগণেশের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে— এটাই খয়রাতির কল্যাণ-অর্থনীতির চর্চায় একটা নতুন স্রোত বইয়ে দিতে পারে। তার ঢেউ সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এ দেশেও পৌঁছবে বিলক্ষণ।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy