Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
প্যাকেটে ওজন কমা মানেও দাম বাড়া, কিন্তু তাতে কষ্ট কম হয়
Price Hike

দাম বাড়ানো কঠিন কেন

শিবুদা গত তিন মাস ধরে বেপাত্তা ছিলেন। ফ্ল্যাটের দরজায় তালা, ফোন বন্ধ, ইমেলের উত্তর দিচ্ছেন না।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২২ ০৪:৪৫
Share: Save:

কাল বুঝলি একশো টাকা দিয়ে এক কেজি লিচু পাতা কিনলাম, বাড়ি এসে দেখলাম তার সঙ্গে কয়েকটা লিচুও ফ্রি দিয়েছে!” হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডে পাওয়া চুটকিই নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে ফিক ফিক করে হাসল তপেশ। শিশির বলল, “এক প্যাকেট ব্র্যান্ডেড হাওয়া কেন, দেখবি ওরাও সঙ্গে কয়েকটা পট্যাটো চিপস ফ্রি দেবে!”

সূর্য সুদোকু করছিল, কাগজটা হাত থেকে নামিয়ে বলল, “ইহার নাম শ্রিঙ্কফ্লেশন। ইতিমধ্যেই যদি না পড়ে বা শুনে থাকিস, শব্দটা জেনে রাখ— শ্রিঙ্ক আর ইনফ্লেশন জুড়ে তৈরি হয়েছে। প্যাকেটে জিনিসের পরিমাণ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি ম্যানেজ করার কৌশল। কর্পোরেটরা বাঘা বাঘা ম্যানেজমেন্ট স্কুলে পড়ে, গন্ডাখানেক কনজিউমার্স সার্ভে করিয়ে যা শিখেছে, বাজারের লিচুওয়ালা নিজের বুদ্ধিতেই সেই খেলা ধরে নিয়েছে— নগদ দাম বাড়ানোর বদলে ওজন কমিয়ে দেওয়া।”

শিবুদা গত তিন মাস ধরে বেপাত্তা ছিলেন। ফ্ল্যাটের দরজায় তালা, ফোন বন্ধ, ইমেলের উত্তর দিচ্ছেন না। তপেশরা পুলিশে জানাবে কি না ভাবছে যখন, দু’লাইনের একটা ইমেল এসেছিল শিবুদার কাছ থেকে— জুনের গোড়ায় ফিরছি, চিন্তা করিস না। গত কালই কলকাতায় ফিরেছেন শিবুদা, কাজেই আজ গোপালের দোকানে তাঁর পদধূলি পড়েছে। কোথায় গিয়েছিলেন, কেন গিয়েছিলেন, এই সব প্রশ্নের উত্তরে স্পিকটি নট। তবে, হাতে করে নিয়ে আসা ডার্ক চকলেট আর বিলিতি সিগারেটের প্যাকেট দেখে মালুম হচ্ছে বিদেশ থেকে ফিরলেন।

চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে শিশির বলল, “একটা আর্টিকল পড়ছিলাম দিনকয়েক আগে। দেখে তো তাজ্জব— ইনস্ট্যান্ট নুডল থেকে বাসন মাজার সাবান, বিস্কুট থেকে টয়লেট পেপার, সব কিছুর ওজন কমে যাচ্ছে। যত্ত মানুষ ঠকানো কারবার! এর চেয়ে সরাসরি দাম বাড়ালে ক্ষতিটা কী হয়?”

“ক্ষতি অনেক কিছুই হতে পারে, কিন্তু কথাটা হল, মানুষ ঠকবে কেন? প্যাকেটের গায়ে আগেও দাম আর ওজন, দুটোই লেখা থাকত, এখনও থাকে— তুই হিসাব কষে নিতে পারিস না, ওজন কমানোয় আসলে দাম কতটা বাড়ল?” এত ক্ষণে মুখ খুললেন শিবুদা। শিশিরকে অবশ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে দিলেন না, নিজেই বললেন, “হিসাব কষতে পারিস না, কারণ আগের প্যাকেটে কত গ্রাম জিনিস ছিল, সেটাই তুই জানিস না। পাঁচ টাকার চিপস-এর প্যাকেটে কত গ্রাম চিপস থাকে, জানিস? ওটার দাম পাঁচ টাকা, সে কথাটা জানিস। বাসন মাজার সাবানের ছোট বার মানে কত গ্রাম, গ্লুকোজ় বিস্কুটের পাঁচ টাকা দামের ছোট প্যাকেটের এক-একটা বিস্কুটের ওজন কত গ্রাম, কোনওটাই জানিস না। জিনিসগুলোকে তুই দাম দিয়ে চিনিস।”

শিশিরের দিকে বিলিতি সিগারেটের প্যাকেটটা ঠেলে দিয়ে ওর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরালেন শিবুদা। লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। বাকিরা চুপ করে আছে দেখে নিজের কথার খেই ধরে নিলেন আবার, “এই যে কিছু জিনিসকে আমরা দাম দিয়ে চিনি, সেটা কিন্তু অকারণে নয়। কোম্পানিগুলো আমাদের ও-ভাবেই চিনিয়েছে। ভারতের বাজারের চেহারাটা অদ্ভুত— এখানে ক্রেতার সংখ্যা বিপুল, কিন্তু বেশির ভাগেরই ক্রয়ক্ষমতা কম। তাদেরকে দিয়ে যদি এমন জিনিস কেনাতে হয় যেগুলো না কিনলেও চলে, তা হলে জিনিসের দাম শুধু তাদের নাগালের মধ্যে আনলেই হবে না; দাম যে নাগালের মধ্যে, সেটা মাথায় গজাল মেরে গেঁথে দিতে হবে। বিজ্ঞাপন দেখ, জিনিসের প্যাকেজিং দেখ— সবেতেই দামের কথাটা বারে বারে মনে করিয়ে দেওয়া হয়। সেই স্ট্র্যাটেজি বিলক্ষণ কাজও করে। কাগজে এখন নানান কোম্পানির বিক্রির হিসাব বেরোচ্ছে— এই যে সবচেয়ে কম দামি প্রোডাক্ট, কোনও কোম্পানির মোট বিক্রির ৫০ শতাংশ আসে এখান থেকে, কোনও কোম্পানির ৭০ শতাংশ।

“তোদের প্রাইস অ্যাঙ্করের কথা বলেছিলাম আগে, মনে আছে? ওই যে, কোন জিনিসটার কত দাম, আমাদের মাথায় তার একটা হিসাব থাকে, আর কোনও জিনিস কেনার সময় সেই দামের সঙ্গে আমরা জিনিসটার দাম তুলনা করে দেখি? দামের হিসাবটা তো স্বাভাবিক ভাবে কিলোগ্রামপ্রতি, অথবা লিটারপ্রতি হিসাব হওয়ার কথা। কিন্তু, এই যে কোম্পানিগুলো আমাদের মাথায় গজাল মেরে পাঁচ টাকা বা দশ টাকা দামের কথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে, তার সঙ্গে ওজনের হিসাবটা ঢোকায়নি। ফলে, চিপস-এর প্যাকেটের দামের অ্যাঙ্কর আমাদের মাথায় পাঁচ টাকা— তাতে কত গ্রাম চিপস আছে, সেটা আমাদের হিসাবে নেই। ভারতের এফএমসিজি কোম্পানিগুলো একটা কথা প্রায়ই বলে, ‘সেক্রেড প্রাইস পয়েন্ট’— এমন একটা দাম, যার থেকে নড়চড় করলেই হুড়মুড়িয়ে বিক্রি কমে যেতে পারে। দু’টাকা, পাঁচ টাকা আর দশ টাকা হল ভারতের বাজারের সেই সেক্রেড প্রাইস পয়েন্ট। কোম্পানিগুলোরই তৈরি করে দেওয়া প্রাইস পয়েন্ট এগুলো, কিন্তু আমাদের মাথায় তার অ্যাঙ্কর এমনই গেঁথে আছে যে, সেখান থেকে সরলেই ক্রেতাদের মনে ক্ষতির অনুভূতি তীব্র হয়ে ওঠে। মানুষ স্বভাবতই ক্ষতিবিমুখ, ভারতীয় ক্রেতারা আরও বেশি প্রাইস সেনসিটিভ। ফলে, কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে দামের পয়েন্ট থেকে নড়া ভয়ঙ্কর কঠিন। ভেবে দেখ, কত যুগ ধরে শ্যাম্পুর স্যাশে এক টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে দাম বাড়ানো অতটা না হলেও মোটের উপর কঠিন; আবার যে সব জিনিসের মোটামুটি ২০ টাকার বেশি দাম, সেখানে দাম বাড়ানো খুব একটা কঠিন নয়।”

“কিন্তু শিবুদা,” একটা ডার্ক চকলেট মুখে পুরে র‌্যাপারটাকে বল বানাতে বানাতে প্রশ্ন করে তপেশ, “প্যাকেটে জিনিস কম দিয়ে আর কত দিন খরচ সামলাতে পারবে এফএমসিজি কোম্পানিগুলো? দাম তো কোনও না কোনও দিন বাড়াতে হবেই।”

শিবুদাও একটা চকলেট মুখে পুরলেন, “সেটা অবিশ্যি ঠিকই— খালি প্যাকেট তো আর ক্রেতার হাতে দেওয়া যায় না! দেখ, প্যাকেটপিছু ওজন কমলে এক দিকে তো প্যাকেটপিছু উৎপাদনের খরচ কমে। তার উপর, এক লরিতে একই ওজনের মাল তোলা হলেও তাতে প্যাকেটের সংখ্যা বেশি হয়, ফলে প্রতি প্যাকেটে পরিবহণ ব্যয় কম। ডিলারের, খুচরো বিক্রেতার কমিশন কমায় অনেক কোম্পানি। কখনও কখনও আবার সবচেয়ে কম দামের প্যাকেটে ক্ষতি করেও জিনিস বেচে কোম্পানিগুলো— বেশি দামের প্যাকেট থেকে করা লাভ দিয়ে সেটা পুষিয়ে নেয়। কিন্তু, এরও একটা লিমিট আছে। খরচ তার উপর গেলে দাম বাড়াতেই হয়। এমনটাও হতে পারে যে, যতগুলো কোম্পানি কোনও একটা নির্দিষ্ট প্রাইস পয়েন্টে একই পণ্য বেচছে, তারা সবাই দাম এক সঙ্গে বাড়াল— কোল্ড ড্রিঙ্কের ক্ষেত্রে হামেশাই যেটা হয়। মানুষও বাধ্য হয়ে নিজেদের অ্যাঙ্কর পাল্টায়।

“কিন্তু, তার চেয়ে কঠিন হল একা দাম বাড়ানো। ধর যে বিস্কুটের প্যাকেটের দাম আমার মাথায় পাঁচ টাকা গেঁথে আছে, কাল সেটার জন্যই সাত টাকা চাইলে আমি কিন্তু মোটেও ভাবব না যে, বিস্কুট তৈরি করতে যে কাঁচামাল লাগে, তার অনেক দাম বেড়েছে— ময়দা থেকে পাম তেল, চিনি, সবেরই। আমার মনে ক্ষতির ভাব প্রবল হবে— এত দিন যার জন্য মাত্র পাঁচ টাকা দিতে হত, এখন সেটার জন্যই সাত টাকা দেওয়া! এই রকম ক্ষেত্রে বেশির ভাগ কোম্পানিই তাদের পণ্যটাকে রিপজ়িশন করে। অর্থাৎ, সাত টাকা দামে যে পণ্যটা তারা বেচতে চাইছে, সেটা যে আগের পাঁচ টাকা দামের পণ্যের চেয়ে আলাদা, এই কথাটা বিভিন্ন ভাবে ক্রেতাকে বোঝায়। বিস্কুটের প্যাকেট বিক্রি করার সময় কেউ হয়তো চারটে ইংরেজি বর্ণ পাশাপাশি লিখে নতুন একটা অ্যাক্রোনিম তৈরি করল, এবং বলল যে, এটা বাচ্চাদের স্মৃতিশক্তি বাড়াতে পারে। কেউ বলল, এতে আছে ২৫ শতাংশ বেশি ফাইবার বা ভিটামিন বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস, বা অন্য কিছু। কেউ আবার বলতে পারে যে, এর স্বাদ আগের চেয়ে অনেক চনমনে। মোট কথা, সাত টাকার বিস্কুটের প্যাকেটটা যে পাঁচ টাকার প্যাকেটের চেয়ে আলাদা, এটা প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ক্রেতা যদি নতুন প্যাকেটটাকে নতুন পণ্য হিসাবে দেখে, তা হলে আর আগের অ্যাঙ্কর কোনও প্রভাব ফেলবে না। এই ‘নতুন পণ্যের’ জন্য ক্রেতার মনে কোনও পূর্বনির্ধারিত দাম নেই।” গোপালের দিয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিলেন শিবুদা।

“অনেকের মুখেই শ্রিঙ্কফ্লেশনের কথা শুনছিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কেন হচ্ছে, সেটা আপনি বলার আগে ধরতে পারিনি।” অনেক ক্ষণ চুপ করে শোনার পর প্রশ্ন করে সূর্য, “আচ্ছা, বেশি দামের জিনিসের ক্ষেত্রে এমন সেক্রেড প্রাইস পয়েন্ট তৈরি হয় না কেন?”

“কোম্পানিগুলো তৈরি করতে চায় না বলে হয় না,” উত্তর দিলেন শিবুদা। “ভারতের সব ক্রেতাই প্রাইস সেনসিটিভ, কিন্তু গরিবের ক্ষেত্রে সেটা বাধ্যতামূলক, তাদের হাতে খরচ করার মতো টাকার অভাব বলে। অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্নদের ধরার জন্য সর্ব ক্ষণ সস্তার হাতছানি দিতে হয় না— তাদের কাছে পুষ্টি, ফ্যাশন, লাইফস্টাইল, এ রকম আরও অনেক গল্প বেচা যায়। ফলে, সেই সব সেগমেন্টে দাম বাড়ানোও তুলনায় সহজ।”

শিবুদা উঠে পড়লেন। প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে অনেকগুলো চকলেট তুলে নিলেন। সেগুলো গোপালকে দিয়ে বললেন, বৌকে দিস। এক সঙ্গে বসে চকলেট খেলে ভালবাসা বাড়ে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Price Hike Price
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy