Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
বিজেপি গরিবকে সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু বৈষম্যের কারণ ঘোচায়নি
BJP

লড়াইটা মর্যাদার, শ্রেণির নয়

যে হেতু দরিদ্র মানুষ এখন একটু হলেও উন্নত জীবনযাত্রার আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লড়াইটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এখন তাঁদের কাজ।

দীপঙ্কর গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২২ ০৪:৪৩
Share: Save:

উত্তরপ্রদেশ ও সামগ্রিক ভাবে হিন্দি বলয়ে বিজেপির এত ভাল ফলাফল কী কারণে, ইউরোপীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস খতিয়ে দেখলে তা বোঝা যেতে পারে। ব্রিটেনে যেমন ১৮৫০ সালের পর থেকে গত একশো বছরের নির্বাচনে শ্রমজীবী শ্রেণির প্রতি সম্মান দেখানোটাই ছিল মূল বিষয়, কর্মসংস্থান তত নয়। বিজেপির সাম্প্রতিক প্রতিশ্রুতি ও ফলাফল দেখলে মনে হয় দলটি যেন জেনে অথবা না-জেনেই ইউরোপীয় ইতিহাস, আরও স্পষ্ট করে বললে আধুনিক ব্রিটিশ ইতিহাসের একটা পাতা তুলে এনেছে।

ব্রিটেনে শ্রমিক শ্রেণির সম্মান ও মর্যাদার উত্তরণের উদ্যোগটা করা হয়েছে ধাপে ধাপে— তার পর এক সময় সেটা গতি পেয়েছে। প্রথমে এসেছে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বের অধিকার, তার পর ভোটাধিকার, তার পর উন্নত বাসস্থান, শিশুশ্রম দূরীকরণ, কাজের সময় বেঁধে দেওয়া, দুর্ঘটনা ও বার্ধক্যজনিত বিমা, শেষে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগসুবিধা। ক্লাস ওয়ার বা শ্রেণিসংগ্রামের চেয়ে ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ যাতে অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, তাকে স্টেটাস ওয়ার বা সামাজিক মর্যাদা অর্জনের সংগ্রাম বলা যেতে পারে। এই সব পদক্ষেপেরই লক্ষ্য ছিল সাধারণ দরিদ্র মানুষকে অসুখবিসুখের সময়, বার্ধক্যে ও বেকারত্বে সাহায্য করা, এই সব সমস্যার মোচন করে তাঁদের উদ্ধার করা নয়।

নরেন্দ্র মোদী তাঁর স্বভাবগত চতুর ভঙ্গিতে এই জায়গাটাকে ঠিকঠাক ধরেছেন, এবং রাজনীতিতে তার প্রয়োগ করেছেন বিলক্ষণ। তিনি ‘কামদার’ ও ‘নামদার’-এর বৈষম্য এবং দুইয়ের মধ্যে অন্তর্নিহিত বিরোধ ও সংঘাতের কথা বলেন, গরিব আর ধনীর বৈষম্যের কথা নয়। মোদী বিলক্ষণ জানেন যে, দরিদ্র মানুষও ধনী হতে চান— এটা অবশ্য স্বতঃসিদ্ধ, কে না ধনী হতে চায়— কিন্তু, এত কাল ধরে তাঁদের উপরে সমাজকাঠামোর অন্তর্নিহিত যে মর্যাদার বৈষম্যের ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটিকে তাঁরা অত্যন্ত অপছন্দ করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, মর্যাদার এই বৈষম্যের ফলেই তাঁরা নিজেদের প্রকৃত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারেননি। উপরন্তু, অর্থনীতির পরিসরে এক ঘটনার অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে, একই আখ্যানকে বহু রকম মোচড় দিয়ে পেশ করা যেতে পারে, যে কোনও পরিসংখ্যানকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া যেতে পারে নিজেদের মনপসন্দ গল্প— সব দলই তা করে এসেছে।

ব্রিটেনে যখন প্রাথমিক ভাবে বিভিন্ন দিক থেকে মর্যাদার বৈষম্য কমানো সম্ভব হল, তখন তাতে ভর করে ব্রিটিশ শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবি করল যে, শ্রমজীবী পরিবারগুলির শিশুদেরও ‘শিক্ষার বিলাসিতা’ দেওয়া হোক। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের মতোই তারাও কেন দর্শন, সাহিত্য, গণিত পড়বে না? কেনই বা তাদের সটান কারিগরি শিক্ষার খোলসে পুরে দেওয়া হবে? এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক প্রসারক্ষেত্র হিসাবে স্থাপিত হল ইউনিভার্সিটি অব রিডিং, ১৮৯২ সালে।

বেঞ্জামিন ডিজ়রেলি ঘোরতর রক্ষণশীল মতাদর্শের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও শ্রমিকদের উন্নত বাসস্থানের জন্য লড়েছিলেন, যেমন ডেভিড লয়েড জর্জ দরিদ্রদের বেকারত্ব বিমার জন্য জনমত গঠনের কাজে প্রচার করেছিলেন। দ্বিতীয় ব্যাপারটির ক্ষেত্রে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে লয়েড জর্জের পূর্বসূরি, ‘লিবারাল’ হার্বার্ট অ্যাসকুইথ-এর অবদানের কথাও বলতে হয়। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি প্রায় একই রকম কাজ করেছে। তারা শ্রেণির প্রসঙ্গ সরিয়ে রেখে তুলে ধরছে মর্যাদার বিষয়টি, ইউরোপে ডেমোক্র্যাটরা আগেই যেমনটা করেছিলেন।

ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া, গৃহনির্মাণে আর্থিক সহায়তা, শৌচাগার তৈরি, রান্নার গ্যাস ও রেশন-বৃদ্ধির ব্যবস্থা— সাধারণ মানুষের মতে যে বিষয়গুলির সঙ্গে সামাজিক মর্যাদারক্ষার প্রশ্নটি জড়িত, বিজেপি সেগুলিকে সামনে নিয়ে এসেছে দক্ষ ভাবে। এতে তাদের লাভও হয়েছে বিস্তর, বিশেষত ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলে, যেখানে দারিদ্র সবচেয়ে বেশি, এবং বেশির ভাগ মানুষের কাছে একেবারে প্রাথমিক সুযোগসুবিধাও যথেষ্ট পৌঁছয়নি। এই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষেরা সব সময়ই দরিদ্র ছিলেন— যুগের পর যুগ ধরে তাঁদের কাজ আর ভাল মজুরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা হয়েছে; কিন্তু কখনও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি।

এ কথা বুঝেই বিজেপি শ্রেণি সংক্রান্ত উদ্বেগের বিষয়টি এক পাশে সরিয়ে রেখে সে জায়গায় সোৎসাহে প্রচার করেছে মর্যাদার বিষয়টি। সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে, তাঁদের বাড়ি তৈরি করে দিয়ে, বাড়িতে শৌচাগার বানিয়ে, গ্যাস সিলিন্ডারের সংযোগ দিয়ে, রেশনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে বিজেপি সরকার গরিব মানুষের কাছে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নকারী সুবিধাগুলি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রে বিজেপির স্বচ্ছ ভারত মিশনের বিরাট ব্যাপ্তি আশ্চর্য করার মতো। খেয়াল রাখা দরকার, সারা দেশে পরিবারপ্রতি শৌচাগারের অনুপাতের হিসাব-সারণিতে এই রাজ্যগুলি ছিল একেবারে তলায়। সেই রাজ্যগুলোই আজ উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের জন-প্রবণতা থেকে ১০০ শতাংশ মুক্ত বলে নিজেদের ঘোষণা করছে।

এই অঞ্চলগুলিতে বিজেপির ভাল ফলাফলে আশ্চর্যের কিছু নেই; কয়েকটি রাজ্য বিজেপি-শাসিত এবং মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে এই সে দিনও তারা ক্ষমতায় ছিল। বিরোধীরা যেখানে কোনও না কোনও ভাবে শ্রেণির প্রশ্নটিকে নিয়ে পথে নেমেছে, এবং ভোটে হেরেছে, বিজেপি সেখানে জয় পেয়েছে মর্যাদার বিষয়টি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে বিতর্কিত প্রশ্নটি সম্ভবত উজ্জ্বলা প্রকল্প। কিন্তু, সেই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তথ্যের অধিকার আইন প্রয়োগ করে পাওয়া পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলির সময় রাজ্যে রাজ্যে রান্নার গ্যাসের নতুন সংযোগের সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে কি ভোটে প্রভাব পড়ে না?

ইউরোপের অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে— আইন করে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও তার ফলে সোশ্যাল মোবিলিটি বা সামাজিক চলমানতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিক মানুষেরা শক্তিশালী হয়েছিলেন, অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে টিকে থাকার লড়াই আর নিজস্ব শ্রেণিসংগ্রামও তাঁরা লড়েছিলেন শক্ত হাতে। এই সব কিছুই মালিকপক্ষকে বাধ্য করেছিল ভাল মজুরি দিতে, তা না হলে শ্রমশক্তিকে হারানোর বিপদে পড়তে হত। যে হেতু শ্রমিকরা স্বাস্থ্য বিমা, শিক্ষা ও বাসস্থানের সুবিধা আদায় করতে পেরেছিলেন, ফলে তাঁরা তুলনায় সহজে বেশি মজুরির দাবি করতে পারেন, ঘরে ভয়ঙ্কর দুরবস্থার ভয় না করেই।

সামাজিক মর্যাদার প্রয়োজন মিটলে তবেই শ্রেণি বিষয়টি গুরুত্ব পায়। দেশে আইন করে ন্যূনতম মজুরির হার বেঁধে দেওয়া হয়েছে বলেই শ্রমিকরা উন্নততর মজুরির দাবি করতে পারেন, তা নয়—তাঁরা তা দাবি করতে পারেন, কারণ এখন তাঁরা নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর মতো জোর অর্জন করতে পেরেছেন। সরকারি সাহায্যে বাসস্থান ও শৌচাগার নির্মাণ, রেশন, গ্যাস সিলিন্ডার আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিজেপি আসলে দরিদ্র জনসাধারণকে এমন এক মর্যাদার বিস্তার দিয়েছে, যা তাঁরা এর আগে কখনও পাননি। একমাত্র মর্যাদার প্রসারের পরেই শ্রেণিগত উত্তরণ সম্ভব।

যে হেতু দরিদ্র মানুষ এখন একটু হলেও উন্নত জীবনযাত্রার আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লড়াইটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এখন তাঁদের কাজ। শ্রেণিসংগ্রাম উপযুক্ত ভাবে হতে পারে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, সরকারের তাতে থাকা উচিত রেফারির ভূমিকায়, অংশগ্রহণকারীর ভূমিকায় নয়। সুতরাং ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, এ হল শ্রেণির লড়াইয়ের আগেও মর্যাদার লড়াই, আর বিজেপি এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে।

স্লোগানটা তাই হওয়া উচিত— ‘দুনিয়ার মর্যাদাসন্ধানীরা এক হও’।

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Uttar Pradesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy