নিরুপায়: ইউক্রেনের নারী-শিশু সীমান্ত পেরিয়ে পোল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছেন, ৯ মার্চ। রয়টার্স
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের এক দিন পরে আহূত রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে ভারত ভোটদান করা থেকে বিরত থাকল, বা বলা ভাল কোনও পক্ষ নির্বাচন করল না। ১ মার্চে দ্বিতীয় দফার প্রস্তাবেও আরও তেরোটি দেশের সঙ্গে ভারত আবার বিরত থাকল ভোটদানে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা এবং অবশ্যই ভারতের বৈদেশিক কূটনীতিকরা মনে করছেন যে, নিরপেক্ষ থাকাটাই ভারতের পক্ষে এখন সুবিধাজনক অবস্থান। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রক্ষার ক্ষেত্রে এটি-ই সঠিক রাস্তা বলে মনে করছেন অনেকে, যদিও সে বিচার প্রশ্নাতীত নয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে ভারত এবং বহু উন্নয়নশীল দেশের জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যে পিছনে ফেলে এসেছে ভারত, সেটা অনুধাবন করতে সময় লাগছে বলেই কি নীতি নির্বাচনে এই অস্পষ্টতা? নেহরুর রাশিয়া প্রীতির দিনও অস্তমিত বহু আগেই, অথচ তাঁর সদা সমালোচনায় মুখর অধুনা ভারত সরকার কিন্তু ‘সর-পে লাল টোপি রুশি’র ধারণা থেকে বেরোতে পারেনি। একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং আর্থ-রাজনৈতিক আদান-প্রদানের নিরিখে নিরপেক্ষতার গুরুত্ব এখন সামান্যই। দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রেও নিরপেক্ষ বিবেকবান নাগরিককে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না কেউ।
নিন্দা প্রস্তাবে বিরত থাকার অব্যবহিত পরে আমেরিকা বলেছে যে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বিষয়টা বোঝে, তাই খুব আশ্চর্য হচ্ছে না। তা হলে এত দিন যে নতুন করে আমেরিকার প্রতি প্রীতি প্রদর্শন হল তা ভারতীয়দের নজর ঘোরাতে, যদিও মনে মনে রাশিয়ার ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর শাসকদেরই পছন্দ করে সরকার? জার্মানির চ্যান্সেলর বলেছেন যে তিনি আশা করেন ভোটদানের পরবর্তী পর্যায়ে ভারত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে। যদি ধরে নেওয়াও যায় যে একমুখী পশ্চিমি স্বার্থের চাপে ভারত মাথা নোয়াবে না, এবং ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় তা প্রয়োজন, তা হলেও অন্তত দু’টি বিষয় আছে যেগুলোর তাগিদে ভারতের নিন্দা প্রস্তাবে সায় দেওয়া উচিত ছিল বলে মনে হয়। এ ছাড়াও, ইউক্রেন যদি ডনবাস, ডনেৎস্ক-এ গণহত্যা করে থাকে, তা হলেও রাশিয়ার দিক থেকে পুরো একটি দেশকে আক্রমণ করার যুক্তি থাকে কি? ইউক্রেনের অন্তর্গত ক্রাইমিয়া, ডনেৎস্ক-এ অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি রয়েছে যারা রাশিয়ার সঙ্গে মিলিত হতে চায় বা পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি চায়। ইউরোপে এ রকম ছোট ছোট দেশের অভাব নেই। তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকে। কিন্তু তাই বলে গোটা দেশ আক্রমণের মতো চরম পরিণতি ঘটে না। আর একটা কথা। রাশিয়ার যুদ্ধ ঘোষণার বিরুদ্ধে মুখ বন্ধ না রাখলে ভারতের উপর ৫০০ টনের মহাকাশ স্টেশন ফেলে দিতে পারে বলে সে দেশ ভয় দেখাতেও পারে কি?
ভারতের স্থায়ী বন্ধু নির্বাচনের বিষয়ে কতকগুলি কথা স্মরণে রাখা যেতে পারে। এক, ভারতের কাছ থেকে আমেরিকা ৫১ হাজার কোটি ডলারের রফতানি করে থাকে বছরে, যা সময়ের সঙ্গে বেড়ে চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো মিলিত ভাবে ভারতের ১৪% রফতানি কিনে থাকে। তুলনামূলক ভাবে, রাশিয়ার অবস্থান ভারতের রফতানির ক্রমতালিকায় ২৫ নম্বরে, মাত্র ২৭০০ কোটি ডলার ব্যবসার গন্তব্যস্থল। সুতরাং কোনও কারণে পশ্চিমি দেশগুলোর তরফে ভারতের উপর আর্থিক বিধিনিষেধ আরোপিত হলে ক্ষতির সম্ভাবনা যে অনেক বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া, ইউরোপ আমেরিকায় যত ভারতীয় বসবাস করেন তার ১%-ও রাশিয়ায় বাস করেন না। সুতরাং, অভিবাসী জনসমর্থন এবং প্রয়োজনে অর্থসাহায্য করার ক্ষেত্রে কার পাল্লা ভারী, সেটাও পরিষ্কার।
দুই, ব্যবসায়িক বিচার বাদ দিয়ে যদি শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে বন্ধু নির্বাচন করা হয়, তা হলেও কি এই নিরপেক্ষতা যুক্তিসঙ্গত? নিন্দা ভোটে ভারতের সঙ্গে চিন এক দিকে হলেও, চিন যে রাশিয়ার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার অজস্র প্রমাণ রয়েছে। যদি কোনও দিন চিন মারফত ভারতের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে যেমন প্রায়শই ঘটছে, তখন রাশিয়ার সমর্থন কোন দিকে যাবে বলে মনে করে ভারত?
আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার চলে যাওয়া এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়। ভারতকে ‘একলা চলো’র বার্তা দেওয়া এই পরিবেশ কি নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে না যে, কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্ক এখন বেশি কাম্য? লক্ষণীয়, ফিনল্যান্ডের মতো নির্বিবাদী এবং রাশিয়ার এক সময়ের উপনিবেশ, এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। পশ্চিম ইউরোপে তো ভারত-বোদ্ধা কম নেই। এদের এক সময়ের চিন প্রীতি, পুঁজিনিবেশ ও তার থেকে বিরাট প্রাপ্তি চিনের উৎপাদন ব্যবস্থার মূলে। তবে নিজেদের সৃষ্টিই যে এক দিন ছাপিয়ে যাবে তা কল্পনার অতীত ছিল এই দেশগুলোতে। ফলে, বিশেষত গত কয়েক বছরে চিনের আগ্রাসী ব্যবসার বিরুদ্ধে এ সব দেশ যোগ্য বিকল্প খুঁজছে: এমন কোনও দেশ যা চিনের মতো নয়। এই পরিস্থিতিতে ভোটদান থেকে বিরত থাকার মধ্যে চিন্তার জন্যে সময় চাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভারত বিশ্ববন্ধু বলে ভোটদানে বিরত, এই যুক্তি অর্থহীন।
একতরফা যুদ্ধ ঘোষণার নিন্দা করলেই সমস্যা মিটবে না তা নিশ্চিত। ভারত যে যুযুধান দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে তার একটা সম্ভাবনা ভোটদান থেকে বিরত থাকার মধ্যে রয়েছে, কিন্তু এযাবৎ ঘটে যাওয়া ছোট-বড় যুদ্ধে ভারত তা সফল ভাবে করেছে তার প্রমাণ তেমন নেই।
রাশিয়ার নিন্দে করলে তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস পেতে অসুবিধে হবে? না কি, রাশিয়া থেকে কেনা অস্ত্র আর মিগ যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশের আমদানি ধাক্কা খাবে? এগুলো এখনও যদি দেশে উৎপাদন করা না যায়, তা হলে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ব্যাপারটাই বা কী? রাজনীতিতে ‘একলা চলো’র শক্তি আসে আর্থিক ক্ষমতার হাত ধরে। চিনের তা আছে। ভারতকে তা পেতে গেলে রাশিয়ার থেকে উন্নত কারিগরি দক্ষতা এবং আর্থিক সংস্থান সম্বলিত দেশের বন্ধু হতে হবে স্থায়ী ভিত্তিতে। বৈদেশিক কূটনীতিকরা এতে দ্বিমত পোষণ করলে বিপদে ভারতের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে বিশেষ কেউ থাকবে তো?
অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy