পশ্চিমবঙ্গ এখন যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে চলেছে, তা আগামী কাল ভোরে ঘুম থেকে উঠলেই মিলিয়ে যাওয়ার নয়। এই দুঃসময় রাজ্যের মানুষই দীর্ঘ দিন ধরে সৃষ্টি হতে দেখেছেন এবং হতে দিয়েছেন শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ আর গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করতে। আর্থিক দারিদ্র ছাপিয়ে মানসিক দারিদ্র বাংলার বুকে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে তার থেকেই এই দুঃসময়ের সূচনা। বিগত কয়েক যুগ ধরে উপযুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও সমাজ এবং রাজনীতির ফাঁক-ফোকর দিয়ে যেন তেন প্রকারেণ সাফল্য কিনতে চেয়েছে যারা, তাদের আমরা পোষণ করে এসেছি বিনা প্রশ্নে। এর থেকে সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়ানক মানসিক সমস্যার— এ রাজ্যে যা খুশি করা যায়, কেউ বাধা দেবে না।
অভয়ার মৃত্যুর বিচার ঠিক ভাবে হলেও এই ক্ষতে সাময়িক প্রলেপ পড়বে, কিন্তু তা সারবে না। তা সারাতে গেলে শিক্ষা নিতে হবে অন্য উন্নত দেশের কাছ থেকে, যারা কোনও না কোনও সময়ে এই রকম অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে এবং কঠিন হাতে এর মোকাবিলা করেছে। নিম্নমানের সমাজচিন্তা এবং দুষ্কৃতীনির্ভর রাজনীতি যখন ফেলে আসা জমির দখল নেয়, দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চলেই এর সব থেকে বেশি প্রতিফলন দেখা যায়। কারণ, সেখানে আইনের শাসন রাজনীতির হাতের পুতুল হয়ে দাঁড়ায়। বাংলায় আইনের শাসন এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে দুষ্কৃতীদের হাত থেকে বার করে আনার এই গণ-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সেই ‘ভাঙা জানলা’ সারানোর একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে।
অনেক দিন আগে বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিকদের করা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে উদ্ভব হয় ‘ভাঙা জানলা’ তত্ত্বের। এই কঠিন পরিস্থিতিতে তত্ত্বকথা শোনার সময় নেই আমাদের। কিন্তু এর মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে রয়েছে সমাজের উপর মধ্যবিত্তের, বিশেষ করে তাদের মূল্যবোধের নিয়ন্ত্রণ নতুন করে কায়েম করার চাবিকাঠি। ‘ভাঙা জানলা’র ঘোর বাস্তব-তত্ত্ব অনুসারে যে অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে চূড়ান্ত পারিপার্শ্বিক অব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করেন, তাঁরা সচরাচর বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হয়ে থাকেন। একটি অঞ্চল যদি শুধুই ভাঙাচোরা বাড়ি, অপরিষ্কার রাস্তা, খোলা নর্দমা, গাড়ি চলার রাস্তা অর্ধেক বন্ধ করে ইট-বালির ব্যবসা, এবং অন্ধকার অলি-গলি দিয়ে পরিচিত হয়, সেখানকার বাসিন্দা এবং বহিরাগতদের মনে বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয় যে, এখানে সব কিছু করা সম্ভব। অর্থাৎ, এখানে খুন, রাহাজানি, ড্রাগ ব্যবসা এবং যাবতীয় সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করলেও কেউ দেখতে আসবে না। এখানে পুলিশ ঢুকতে ভয় পায়, স্থানীয় বাসিন্দারা উদাসীন, পুরপিতা-মাতাদের কোনও আগ্রহ নেই এবং এখানকার বাসিন্দারা তাঁদের দিয়ে জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজনও মেটাতে পারেন না, অসামাজিক কাজ করতে তাই বাধা নেই।
আশ্চর্য কিছু নেই। আমাদের মতো দেশে তো বটেই, উন্নত দেশের শহরগুলোর উপকণ্ঠে এই ভাবেই ধর্ম, বর্ণ কিংবা সম্প্রদায়-ভিত্তিক অনুন্নত মহল্লা তৈরি হয়। যেটা বিবেচ্য, তা হল যে ছোট ছোট অপরাধ করে পার পেয়ে যায় বলে এই পরিবেশ থেকে সৃষ্টি হওয়া অপরাধীরা অনেক বড় অপরাধ করার সুযোগ খোঁজে এবং তা পেয়েও যায়। ফলে, সক্রিয় রাষ্ট্রনীতির প্রথা মেনে উন্নত দেশের শহরগুলোতে কোনও ছোট অপরাধও পুলিশের নজর এড়িয়ে যায় না, এবং এর ফলে বড় অপরাধ করার প্রবণতা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। পরবর্তী কালে অবশ্য অনেকে প্রমাণ করেছেন যে, ভাঙা জানলা অপরাধপ্রবণতার মূল নির্ণায়ক নয়, যদিও এ রকম জায়গায় যাঁরা বসবাস করতে বাধ্য হন তাঁরা অনেক ধরনের মানসিক বিকারের সম্মুখীন হন। এ প্রশ্নও উঠেছে যে, ছোট অপরাধ আটকাতে পুলিশের অতিসক্রিয়তায় পুলিশ বাহিনী এবং সরকারি রাজস্বের উপর চাপ বাড়ছে। নিউ ইয়র্কের মেয়র থাকাকালীন রুডি জুলিয়ানি এই তত্ত্ব ব্যবহার করে শহরের অপরাধ আমেরিকার জাতীয় গড়ের নীচে নামিয়ে এনেছিলেন। তবে বিরোধীরা বলেন যে, পুলিশ কিন্তু অনেক বেশি ধরপাকড় করত গরিব এবং কালো মানুষদের, আর সাদা চামড়ার উচ্চবিত্তের অপরাধ দেখতে পেত না।
যদি আইনের শাসন না থাকাটাই ‘ভাঙা জানলা’ বলে কেউ মনে করেন একটি রাজ্যের ক্ষেত্রে তা হলে বাকি বক্তব্য অনেকাংশেই মিলে যায় না কি? যে রাজ্যে ওয়ান-ওয়ে লেখা রাস্তায় উল্টো দিক থেকে গাড়ি, মোটরবাইক, ঠেলা চলতে পারে পুলিশের সামনে, হেলমেটবিহীন তিন জন সওয়ারি নিয়ে বাইক প্রচণ্ড গতিতে চলতে পারে বিনা বাধায়, রাস্তায় কর্পোরেশনের গ্যালন গ্যালন জল পড়ে নষ্ট হয়, ফুটপাত ও রাস্তা আটকে স্টোনচিপ আর বালির ব্যবসা করা যায় মন্ত্রীদের বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, সেখানে নিয়মের তোয়াক্কা কে করে? ‘ভাঙা জানলা’ একটি বঞ্চিত অঞ্চলের সমস্যা বলে শুরু হলেও তা সহজেই ছড়িয়ে পড়ে অন্য অঞ্চলে।
এটাই স্বাভাবিক। রাজ্যের ওই অঞ্চলে যদি অসামাজিক কাজকর্ম করলে কেউ বাধা না দেওয়ার থাকে তা হলে এই অঞ্চলেও তা করা যেতে পারে। রাজনীতির দ্বারস্থ হয়ে এই সমস্যা মেটে না। কতিপয় নিয়মনিষ্ঠ বাসিন্দার আপত্তির থেকে সংখ্যায় বেশি দুষ্কৃতীদের খুশি রাখলে ভোট নিশ্চিত করা যায়। এর ফলে যে কোনও অঞ্চলে এবং প্রতিষ্ঠানে যত বেশি বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে তত বেশি মানুষ নিজেদের গুটিয়ে নেবেন এবং সুযোগ পেলেই অন্যত্র চলে যাবেন। একে এক অর্থে বলে ‘পা দিয়ে ভোট দেওয়া’, অর্থাৎ এই জায়গা পছন্দ না হলে অন্যত্র চলে যাওয়া। এমন প্রতিক্রিয়া নিম্নবিত্তদের মধ্যে কম, কারণ কাজ এবং বাসস্থানের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব থাকলে জীবনধারণ শক্ত হয়। উচ্চবিত্ত, বিশেষত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছেও এই স্থানত্যাগ সহজ নয়, কারণ এঁদের ক্ষেত্রেও কাজ এবং বাসস্থান যে কোনও জায়গায় হতে পারে না। বাকি থাকে মধ্যবিত্ত মানুষেরা, শিক্ষাই যাঁদের একমাত্র মূলধন। নিজেদের গুটিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে এত দিন এঁরাই ভাঙা জানলা দিয়ে দুষ্কৃতীদের ঢুকে পড়া দেখেছেন। সামাজিক ব্যবস্থা থেকে বিরূপ হয়ে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কারণে কিন্তু সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। আমাদের চার দিকে এই ধরনের বহু আশঙ্কা থাকার দরুন দলবদ্ধ ভাবে মেধার প্রস্থান ঘটেছে এবং তা রাজ্যের পুনরুজ্জীবনের আশায় জল ঢেলে দিচ্ছে।
সাধারণ মানুষের তরফে তাই সিস্টেম বদলানোর প্রয়োজনটাই বহু দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে এই সময়ে। যে ক’জন মেধাসম্পন্ন মানুষ, যার মধ্যে ডাক্তাররা অগ্রগণ্য— এখনও রয়েছেন, তাঁদের সুরক্ষা দিতে ভাঙা জানলা বন্ধ করতে হবে। রাজনীতিকরা আর কবে বুঝবেন যে দুষ্কৃতীদের মাথায় তুলে রাখলে ভোটে হয়তো জেতা যায়, কিন্তু সমাজকে বাঁচানো যায় না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy